ঢাকা: জাতীয় কাউন্সিল শেষে বিএনপিতে মূল্যায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন আন্দোলন-সংগ্রামে রাস্তায় মার খাওয়া দলটির সক্রিয় নেতারা। এখন পর্যন্ত ঘোষিত ১৮টি পদে নিজেদের নাম না দেখে তাদের কেউ কেউ আবার হতাশও হয়েছেন।
ক্ষমতা ছাড়ার পর ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে ২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ, খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রতিবাদ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি, নিখোঁজ এম ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত ও ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন পূর্বঘোষিত কর্মসূচি করতে না দেওয়ায় খালেদা জিয়ার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালে বিএনপির ‘হাইপ্রোফাইল’ নেতারা বরাবরই ছিলেন নিষ্ক্রিয়।
কিন্তু কোনো কোনো নেতা ছিলেন ব্যতিক্রম। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা এসব নেতা আন্দোলনের শুরুর দিকে অনুসারীদের নিয়ে মাঠে নেমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কখনো কখনো পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
২০১০ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে প্রথম হরতাল ডাকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। সরকারের দলন-পীড়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ডাকা এ হরতালে শাহবাগ মোড়ে মিছিল পিকেটিং করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের বেধড়ক পিটুনি খান বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।
সূত্র মতে, বর্তমানে কারাগারে আটক এই নেতা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সম্মানজনক একটা পদ (সাংগঠনিক সম্পাদক) আশা করেছিলেন। কিন্তু শনিবার (০৯ এপ্রিল) ঘোষিত সাংগঠনিক সম্পাদকদের তালিকায় এ্যানীর নাম না থাকায় তিনিসহ তার অনুসারী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা হতাশ হয়েছেন।
মহাজোট সরকারের আমলে হরতালে পিকেটিং করতে গিয়ে সব চেয়ে বড় নির্যাতনের শিকার হন তৎকালীন বিরোধী দলের চিফ হুইপ বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে ২০১১ সালের ৬ জুলাই চার দলীয় জোটের ডাকা হরতালে সহকর্মীদের নিয়ে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পিকেটিং করতে গেলে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
ওই সময় অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন জয়নুল আবদিন ফারুক। জাতীয় কাউন্সিল হলে তার জন্য বড় পদ অবধারিত!
কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘোষিত ১৮টি পদে কোনোটিতে ঠাঁই হয়নি দলের জন্য রাজপথে রক্তঝরানো এই নেতার। অবশ্য এ নিয়ে কোনো খেদ নেই জয়নুল আবদিন ফারুকের।
রোববার (১০ এপ্রিল) বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের ওপর আমাদের আস্থা শতভাগ। যোগ্য ও সক্রিয় লোকদের তিনি মূল্যায়ন করবেন- এ বিশ্বাস আমাদের আছে। তাছাড়া পদের জন্য তো রাজনীতি করি না। রাজনীতি করি মানুষের জন্য, দলের জন্য। দলে কোনো পদ না থাকলেও বিএনপির জন্য কাজ করে যাবো’।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে চার দলীয় জোট ঘোষিত হরতাল-অবরোধের সময় নয়াপল্টন কার্যালয় ও এর আশাপাশে হাতে গোনা যে ক’জন নেতাকে দেখা যেতো, তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম।
আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম দিকে তরুণ এই নেতা নয়াপল্টন সড়কে রায়টকার ও জলকামানের সামনে বুক পেতে দিয়ে বলেছেন, ‘চালাও গুলি। নব্বইয়ে স্বৈরাচারী সরকারের গুলি খেয়েছি, মরি নাই। এখন গুলি করে মেরে ফেলো!’
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে চার দলীয় জোটের ডাকা হরতালে গাবতলীতে পিকেটিং করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন নাজিম উদ্দিন আলম। দীর্ঘদিন তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে হয়। ওই ঘটনার পর বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেন খালেদা জিয়া।
সূত্রমতে, এবারের কাউন্সিলে বিএনপির এই তরুণ নেতা দলের যুগ্ম মহাসচিব পদ আশা করেছিলেন। এরই মধ্যে ৭ যুগ্ম মহাসচিবের নাম ঘোষণা হয়েছে, যেখানে তার নাম নেই। তারপরও আশা ছাড়েননি তিনি, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় দল তাকে মূল্যায়ন করবে- এমনটিই তার বিশ্বাস।
মার খাওয়ার ভয়ে সম্পদশালী ও ভিআইপি নেতারা রাস্তায় না নামলেও আন্দোলন-সংগ্রামের পুরোটা জুড়েই বিএনপির ৫ নারী সংসদ সদস্য রাশেদা বেগম হীরা, নীলোফার চৌধুরী মনি, আসিফা আশরাফি পাপিয়া, রেহেনা আক্তার রানু ও শাম্মি আক্তার রাজপথে ছিলেন সক্রিয়।
ওই ৫ সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, নয়াপল্টন, গুলশানসহ হরতাল-অবরোধের সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে নিয়মিত পিকেটিং করেছেন। বার বার শিকার হয়েছেন পুলিশি হয়ারানির।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে ২০১৩ সালের ৭ মার্চ চার দলীয় জোটের ডাকা হরতালে নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে পিকেটিং করার সময় তাদের ৪ জনকে আটক করে পুলিশ।
মাইক্রোবাসে তুলে থানায় নেওয়ার সময় ধ্বস্তা-ধস্তির এক পর্যায়ে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে পড়ে যান শাম্মি আক্তার। ওই অবস্থায়ই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় থানায়।
দলের জন্য রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এভাবে অসংখ্যবার হয়রানির শিকার হয়েছেন বিএনপির সাবেক এই ৫ সংসদ সদস্য। অসংখ্য মামলার আসামিও হয়েছেন তারা। জাতীয় কাউন্সিলের পর এরাও দলের মূল্যায়নের অপেক্ষায় আছেন।
এছাড়া গত ৫ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে দলে মূল্যায়নের দাবিকে যৌক্তিক করে তুলেছেন বর্তমান কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, সেলিমা রহমান, অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সহ তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব, মহিলা দলের সভাপতি নূরে আরা সাফা, সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, ঢাকা মহানগর মহিলা দলের সভানেত্রী সুলতানা আহমেদ, ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী আবুল বাশার, চট্টগ্রামের গোলাম আকবর খন্দকার, বগুড়ার ভিপি সাইফুল, জয়পুরহাটের মজহার হোসেনের মতো নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সক্রিয় ও ত্যাগি নেতারাই পদ পাবেন। তবে পদের চেয়ে নেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবার প্রত্যাশা হয়তো পূরণ হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, কাঙ্ক্ষিত পদ না পেলেও দলকে যারা ভালোবাসেন, দলের জন্য তারা কাজ করে যাবেন’।
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৬
এজেড/এএসআর