দীর্ঘ একযুগ পরে মুক্ত পরিবেশে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় নয়াপল্টন কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম কিনছেন নেতারা। সঙ্গে আসছে হাজার হাজার নেতাকর্মী।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো বিএনপি। এরপর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি না মানায় দলটি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করে। এবার ১০ বছর পর সেই দাবি আদায় ছাড়াই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে তারা।
দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির কয়েক লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-নির্যাতনে যখন জর্জরিত, তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীরা যখন হতাশায় নিমজ্জিত, ঠিক তেমনি একটি সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীরা। গত দুই দিন মনোনয়ন ফরম কেনাকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন জুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদের বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে তেমনটিই মনে হয়েছে।
দলটির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে দলে দলে মিছিল নিয়ে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভিড় করেন নেতাকর্মীরা। সোমবার ও মঙ্গলবার সকাল থেকেই সারাদেশ থেকে আসা মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাকর্মী এবং তাদের কর্মী সমর্থকদের ভিড় লক্ষ করা যায়। মিছিল আর স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে নয়াপল্টন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যা ছড়িয়ে পড়ে ফকিরাপুল মোড় ও কাকরাইলের নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত। চলে রাত ১০টার পর্যন্ত।
দলটির শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন এবং দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান বেশ কয়েকটি মামলায় সাজা হওয়ার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না। ১২ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে পাঁচ বছর ধরে সংসদেও নেই। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জন্মের পর থেকে দলটি এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেনি। এদিকে একটি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ১০ মাস ধরে জেলে রয়েছেন খালেদা জিয়া।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রায়ই বলে থাকেন, তাদের দলকে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। গত ৯ নভেম্বর রাজশাহীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেন, সময় খুব সংকীর্ণ, সংকট আরো ভয়াবহ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে সংকটে পড়ে যাওয়া বিএনপি সরকারের কঠোর আচরণের মুখে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও তেমন সফল হতে পেরেছে বলা যাবে না।
এতসব প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও গতে এক মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেক স্বস্তিরভাব বিরাজ করছে। ড. কামাল হোসেন, আসম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মতো আওয়ামীপন্থি নেতাদের নিয়ে একটি জোট গঠন বিএনপির দুর্দিনে সবচেয়ে বড় সফলতা বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। একই সঙ্গে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণায় নেতাকর্মীদের অধিকতর চাঙ্গা করে তুলেছে।
দলের অনেক নেতাকর্মীদের মতে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ সিদ্ধান্তটি ছিলো অপরিহার্য। দলের দুই কাণ্ডারির অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দলকে সঠিক পথেই পরিচালিত করছেন বলে দাবি করেন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ।
এদিকে, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিপক্ষে যে কেউ নেই তাও বলা যাবে না। দলের একটি অংশ এখনও মনে করছে খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আত্মাহুতি দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, ১০ বছর পরে দেশে নির্বাচনের আমেজ তৈরি হয়েছে। দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন চায়। আগামী নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে হবে বলে আশা করি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশনেত্রীর মুক্তি, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়াসহ সাত দফা দাবি আদায় হবে।
১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া বিএনপি ৮১ সালে তাকে হত্যার পর প্রথম বিপর্যয়ে পড়ে। এসময় দলটির হাল ধরেন তার সহধর্মীনি খালেদা জিয়া। দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীনভাবে নেতৃত্ব দেন তিনি। ফলে ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকে বিএনপি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করে পদত্যাগ করেন খালেদা জিয়া।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিরোধীদল হিসেবে সংসদে ছিলো পাঁচ বছর। ২০০১ সালে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মধ্যে দিয়ে তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে আবারো আন্দোলনে যায় আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ড. ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় বসে। দুই বছর দেশ পরিচালনার সময় সেই সরকার আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে বন্দি করে। এসময় দুই নেত্রীও প্রায় দুই বছর জেলে ছিলেন।
অবশেষে ফখরুদ্দিন সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। মাত্র ৩০টি আসন নিয়ে বিরোধী দলে থাকে বিএনপি। ক্ষমতায় এসে তাদেরই আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয় আওয়ামী লীগ। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যায় বিএনপি।
২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে অনড় থেকে নির্বাচন বর্জন করে দলটি। একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপিকে চাপের মুখে রাখে আওয়ামী লীগ সরকার। এমনি একটি অবস্থায় শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০ দলীয় জোট যখন আন্দোলন করে আসছিল তখন শেখ হাসিনা আবারো তার অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে কারাবন্দি চেয়াপারসন খালেদা জিয়া ও লন্ডনে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের নির্দেশনায় ২০ দলীয় জোট অটুট রেখে নতুন জোট হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। যদিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল কারিগর বিএনপি। তাদের সিদ্ধান্তেই শেষ পর্যন্ত জোট দুটি শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চাঙা হয়ে ওঠে দলীয় নেতাকর্মীরা। বাধভাঙা স্রোতের মতো দলীয় নেতাকর্মীদের নয়াপল্টনে উপস্থিতিকে নির্বাচনী উৎসবের মাতোয়ারাই বলা যায়।
বাংলাদেশ সময়: ০২১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৮
এমএইচ/এনটি