ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাজেট

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের মূল ফোকাস ঠিক নেই, বলছেন অর্থনীতিবিদরা

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৩ ঘণ্টা, জুন ১, ২০২৩
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের মূল ফোকাস ঠিক নেই, বলছেন অর্থনীতিবিদরা

ঢাকা: দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপের মধ্যে প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও বিশাল ঘাটতির বাজেটকে ‘উচ্চাভিলাষী’ এবং বাস্তবতার সঙ্গে খুব একটা মিল নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

একই সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটের মূল ফোকাস ঠিক নেই।

তাই বাজেট বাস্তবায়ন ভেরি ডিফিকাল্ট হবে বলে মনে করেন তারা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিরতার মধ্যে প্রবৃদ্ধির এই টার্গেট অনেক উচ্চাভিলাষী। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরের বছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট ধরা হচ্ছে, সেটা কিছুটা অনুমান নির্ভর। বাজেটে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৷ ওই ঘটতি মেটাতে সরকার যদি বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতিতে বেশি প্রভাব পড়বে না। ফলে বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ধরে রাখাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রধান গুরুত্বে রেখে সরকারকে কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন তারা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্রাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৷ ওই ঘটতি মেটাতে সরকার যদি বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতিতে বেশি প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তাতে ব্যক্তি খাত ঋণ কম পাবে। আবার যদি সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে সরকার টাকা নেয়, সেটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে।

তিনি বলেন, বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রস্তাবিত বজেটে যে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা ‘পূরণ হবে না’। কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আমদানি কমে যাচ্ছে। এই পরিবেশে প্রবৃদ্ধি খুব একটা যে হবে সেটা আশা করা ঠিক না। এ বছর বলা হচ্ছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। সেটাও কমে হয়ত ৫ এর ঘরে চলে আসবে। আগামী বছর যে খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু হবে তা মনে হয় না। অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে প্রধান গুরুত্বে রেখে সরকারকে কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি। সুতরাং আমি বলব এবারের বাজেট বাস্তবায়ন হবে ভেরি ডিফিকাল্ট।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, এইমুহূর্তে অর্থনীতিতে যে উচ্চমূল্যস্ফীতির যে সমস্যা তার সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো বাজেটে ঠিকমতো ফোকাস হয়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চপ্রবৃদ্ধি ও অনেক বেশি বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এগুলো আমার কাছে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত মনে হয়নি। আমার কাছে যেটা মনে হয়, সেটা হলো আগে বাজেটের মূল ফোকাসটা ঠিক করা দরকার। তারপর পরিস্থিতি মোকাবেলায় কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটা নেওয়া।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও বাজেটারি পলিসিতে এবং বাজার মনিটরিংয়ে নজর দিতে হবে। এছাড়া রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যে বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সে বিষয়ে বাজেটে কোন সুস্পষ্ট কথা নেই। কিছু ক্ষেত্রে বাজেটে কর বাড়ানো কমানো কথা বলা হয়েছে সেটাপ্রতি বছরই থাকে। কিন্তু এতবড় কর কাঠামো কীভাবে বাস্তবায়ন করবে তার কোনো, সুস্পষ্ট বর্ণনা নেই। আবার ঋণখেলাপির পরিমাণ কীভাবে কমবে ব্যাংকিংখাতে সংস্কারগুলো কীভাবে হবে এ বিষয়ে সে রকম কোনো কিছু আমি দেখিনি। সুতরাং আমার কাছে মনে হয়, এ বাজেটে সে সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়নি। তাই আমার কাছে মনে হয়, চলমান সংকটগুলো সহসা সমাধান হওয়ার নয়। সুতরাং বলা যায়, বাজেটের মূল ফোকাস ঠিক নেই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অস্থিরতার মধ্যে প্রবৃদ্ধির এই টার্গেট অনেক উচ্চাভিলাষী। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বৃদ্ধি পায়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরের বছরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সেই চর্চা কখনোই হয়নি। এবারও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধির যে টার্গেট ধরা হচ্ছে, সেটা কিছুটা অনুমান নির্ভর, কিছুটা আইএমএফ এর শর্তের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।

প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্য ঠিক করার সময় ঝুঁকির বিষয়গুলো ঠিকঠাক বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, এটা আসলেই একটা আশঙ্কাজনক জায়গায় চলে এসেছে। সেটা পর্যাপ্তভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। এখন রিজার্ভ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। নতুন অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অনুমিতিগুলোর মধ্যে ইতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়া হলেও নেতিবাচক দিকগুলো হয়ত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রায় ‘বাস্তবতার সঙ্গে কিছুটা অমিল’ রয়েছে। সারা বিশ্বেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। বৈশ্বিক ঘটনার কারণে এখানে সরকারের ব্যর্থতা দাবির খুব সুযোগ নেই। তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নির্দিষ্ট একটা জায়গায় ধরে রাখাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য মূল্য যেহেতু মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করে, সেহেতু বাজারে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, সরকার আশাবাদী হয়ে ইতিবাচক কিছু করতে চাইলে সেটা খারাপ নয়। বরং আশাবাদী কর্মকাণ্ডই ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। সরকারের এই আশাবাদী এবং ইতিবাচক মনোভাবকে আমি ভালো মনে করি। গ্রোথ আমাদের হচ্ছে, এর আগে আরো বেশিও হয়েছে। এখন বেশি আশা করতে সমস্যা কী? সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট নেওয়াতে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। আমি মনে করি উন্নত বিশ্ব তাদের নিজেদের স্বার্থেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নেবে। যুদ্ধ বন্ধ করা গেলে মূল্যস্ফীতি ওই মাত্রার মধ্যেই রাখা সম্ভব বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, অনেক সমস্যা আমাদের পাড়ি দিতে হবে। এর মধ্যেও আমাদের ইতিবাচক মানসিকতা থাকতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের মধ্যে অনেকে হতাশায় ভোগেন এবং ভালো হলেও সেটাকে ভালো বলে স্বীকার করতে চান না। এই মানসিকতা কাটিয়ে ওঠা উচিত।

এরআগে বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি।

আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ব্যতীত) ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ টাকা।

মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছর ছিলো ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সেখানে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৪৫ ঘণ্টা, জুন ০১,২০২৩
জিসিজি/এসএএইচ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।