সিলেট থেকে : পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান তখন কেবল শেষ হয়েছে। মাঠে যে ক’জন দর্শক ছিলেন, তারা সবাই জড়ো হয়েছেন গ্যালারির একপাশে।
একটু-আধটু কথাবার্তা বললেন। বারবার কেবল শোনালেন ‘প্রসেস’ আর ‘বেসিকের’ কথা। তাসকিন আহমেদ বোধ হয় সবচেয়ে দামী কথাটা বললেন চলে যাওয়ার ঠিক আগে—‘এসবে কিছু হবে না ভাই, বড় কিছু করতে হবে। অনেক অনেক বড় কিছু। একদিন দেখবেন র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর বোলার হয়ে গেছি। ’
আপনি এখানে কি দেখেন? বড় স্বপ্নটাই নিশ্চয়ই আগে দেখার কথা। তাসকিন আহমেদ কেন, কোথায়, কীভাবে এখনকার ফর্মে; ভালোই জানা থাকার কথা সবার। কান্নায় চোখের জল ফেলা থেকে সাফল্যের চূড়া, তাসকিন দেখেছেন সবকিছু। তিনি তাই বড় স্বপ্ন দেখবেন, স্বাভাবিক কথাই।
কিন্তু এই মন্ত্রটা কেবল তার না। এই চলার পথ এবাদত হোসেনের। এই চাওয়া মোস্তাফিজুর রহমানের। এই গল্পটা হাসান মাহমুদের। অথবা অ্যালান ডোনাল্ডের ভাষায় ‘যারা এখানে নেই’, এই ইচ্ছে তাদেরও। হাসান মাহমুদের চুলে জট বাধা; নিভৃতচারী, মুখ লুকানো স্বভাব তার। কিন্তু জীবনের প্রথম পাঁচ উইকেট পাওয়ার পর সেই সুযোগ আর কোথায়।
আপনি হয়তো একটু অবাকই হবেন শুনে, স্বীকৃত ক্রিকেটে এর আগে কোথাও পাঁচ উইকেট পাননি হাসান মাহমুদ। আজ যখন পেলেন, তার সঙ্গী হলো দারুণ একটা ট্রফিও। সেটা নিয়ে হাসান দাঁড়ান, একজনের পর একজন আসেন; ছবি তোলেন, চলে যান। হাসানের তাই ফিরতে ফিরতে দেরি হয় ড্রেসিং রুমে।
তাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে যেতে চান অধিনায়ক তামিম ইকবাল, তাকে পরে করতে হয় ফোনও। হাসান মাহমুদ নিশ্চয়ই আরও অনেক ছবির আবদার মিটিয়ে এসেছেন। হাসানকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আসতে হয়। যেমন করে পেসাররা আসেন, হয়তো সেভাবেই।
অধিনায়ক তামিম ইকবাল যখন বলছেন পরের কথাগুলো, হাসান মাহমুদ পাশে তখনও, ‘মাঠের বাইরে যে কাজটা পেসাররা করেছে, এটা এখন মাঠে কাজে দিচ্ছে। তাদের এই সফলতা ফ্লুক না, তারা নেটে কঠোর পরিশ্রম করছে। আপনার হাতে যখন এমন একটা পেস বোলিং অ্যাটাক থাকবে, তখন কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ’
‘আপনি যেখানেই খেলছেন, হোম হোক বা অ্যাওয়ে, যে কোনো জায়গায় আরও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠবেন। পুরো পেস বোলিং ইউনিটকে নিয়েই গর্ব হয় আমার। শুধু হাসান পাঁচ উইকেট পেয়েছে বলেই না, অন্য কেউ তিন-চার উইকেট পেয়েছে বলেও না, যেভাবে তারা বল করেছে পুরো সিরিজে সেটা বেশ তৃপ্তি দিয়েছে। ’
কীভাবে ‘কাজ সহজ করে দিচ্ছেন পেসাররা?’ আপনার একটা সহজ উত্তর হয়তো অ্যালান ডোনাল্ড। এর পেছনে আছে অনেকগুলো ছবিও, যেগুলো সবসময় দেখে না কেউ। কেমন? কোনো পেসার বল করছেন ধরুন, সেটি অনুশীলনে অথবা প্রস্তুতি ম্যাচে; ডোনাল্ড গিয়ে দাঁড়াবেন ঠিক উইকেটের সোজা, এরপর ভিডিও করবেন সেটি অনেকক্ষণ ধরে। পরে কী হবে, নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।
কিংবা যে ছবিটা দেখেন আপনি টিভি পর্দাতে, তেমন কিছু— মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে কথা বলছেন ডোনাল্ড, হাসান মাহমুদকে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে তার খুব তাড়াহুড়ো। ডোনাল্ড আসলে কী করেছেন এই পেসারদের সঙ্গে? এর জন্য ডোনাল্ডের মুখেই তার লম্বা একটা উত্তরই শুনতে হবে আপনাকে।
‘যখন আমার এই ছেলেদের সঙ্গে দেখা হয়, এসেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাইনি। তাদের কথা শুনেছি, তারপর প্রশ্ন করেছি। আলাদা করে সবার কাছে জানতে চেয়েছি তাদের খেলাটা কোথায় আছে আর তারা আমার কাছে কী চায়...। কাল আপনাকে নেওয়া হবে কি না ভাবলে এই জায়গাটা আপনার জন্য না। আমি মানসিকতায় নজর দিতে চাই, এই পর্যায়ের সবকিছুই আসলে মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। ’
‘চার-পাঁচ মাস সময় লেগেছে ছেলেদের আমার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করতে। আমার বার্তা পরিষ্কার ছিল- তোমাকে ভুল নিয়ে ভাবতে হবে না। আমিও ভুল করেছি, অনেক ভুল করাতেও কোনো সমস্যা নেই। আমি কেবল একটা পরিকল্পনা দিতে পারি, যদি তারা পছন্দ না করে; ঠিক আছে। ’
হাসান মাহমুদ বোলিংয়ে আগ্রাসী, সুইং করান, ডেথ বোলিংয়ে কার্যকরী; বাস্তবে চুপচাপ। এবাদত হোসেন ‘সিলেট রকেট’। ম্যাচে সবচেয়ে সহজ ক্যাচটা হয়তো তিনি ফেলবেন, কিন্তু অনুশীলনে সংখ্যায় সবার চেয়ে বেশি ক্যাচও ধরেন তিনি। তাসকিন আহমেদ? আপনাকে বলার দরকার নেই বোধ করি।
এসবের সমন্বয়ে কী হয়? বহুদিনের পরিশ্রমের ফল হিসেবে সব উইকেট নেন পেসাররা, প্রথমবার। এরপর? বাংলাদেশ ১০ উইকেটে জেতে প্রথমবার। আর? হাসান মাহমুদ স্বীকৃত ক্রিকেটে প্রথম ‘ফাইফারের’ দেখা পান আন্তর্জাতিক ম্যাচে এসে।
তাসকিন আহমেদ যে ‘প্রসেস’ বা ‘বেসিকের’ কথা বলেন। তাতে কী হয়? বড় স্বপ্ন দেখা। কত বড়? ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর জায়গাটা অথবা বিশ্বকাপ!
বাংলাদেশ সময় : ২১৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২৩
এমএইচবি/এএইচএস