কানপুর টেস্টে ৫ দিনের মধ্যে আড়াই দিন বৃষ্টিতেই ভেসে গেছে। এমন ম্যাচেও যে জয়ের স্বপ্ন দেখা যায়, ভারত যেন তা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল।
শেষ সেশনে সাকিব আল হাসান ও মেহেদী মিরাজ মিলে ঘূর্ণিজাদু দেখালে মাত্র ৫২ রানের লিড নিয়েই ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। জবাবে ১১ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে ২৬ রান তুলে দিন শেষ করেছে বাংলাদেশ। ওপেনার সাদমান ইসলাম ৭ রানে ও মুমিনুল হক রানের খাতা খোলার অপেক্ষায় পঞ্চম দিনে ব্যাটিংয়ে নামবেন।
গত দুই দিন বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও আজ সময়মতোই খেলা শুরু হয়। দিনের শুরুতেই ১১ রান করা মুশফিকুর রহিমকে বোল্ড করেন জাসপ্রিত বুমরাহ। শুরুতে কিছুটা আক্রমণাত্মক থাকলেও মোহাম্মদ সিরাজের কাছে উইকেট হারান লিটন দাস। ৩০ বলে ৩ চারে ১৩ রান আসে তার ব্যাট থেকে। এরপর সাকিব আল হাসানও থিতু হতে পারেননি। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বল হাওয়া তুলে দেন তিনি। পেছনে দৌড়ে গিয়ে অসাধারণ এক ক্যাচ নেন সিরাজ। ফলে ১৭ বলে ২ চারে ৯ রানেই থামে সাকিবের ইনিংস।
একপ্রান্ত আগলে রেখে এর মাঝে অবশ্য ফিফটি তুলে নেন মুমিনুল। এরপর মিরাজকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে থাকেন সেঞ্চুরির পথে। প্রথম সেশনের শেষ ওভারে অশ্বিনকে সুইপে চার মেরে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করেন তিনি। হেলমেট খুলে মিরাজের সঙ্গে উচ্ছ্বাসই বলে দিচ্ছিল মুহূর্তটির জন্য কতটা ব্যাকুল ছিলেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। ক্যারিয়ারে এটি তার ১৩তম সেঞ্চুরি এবং বিদেশের মাটিতে দ্বিতীয়।
১৫ মাস পর পাওয়া তার সেঞ্চুরি সত্ত্বেও লাঞ্চ বিরতির পর ঘণ্টাখানেকও টিকতে পারেনি বাংলাদেশ। গুটিয়ে যায় ২৩৩ রানে। একপ্রান্ত আগলে রেখে সেঞ্চুরি করা মুমিনুল হক অপরাজিত থাকেন শেষ পর্যন্ত। ১৯৪ বলে ১৭ চার ও ১ ছক্কায় ১০৭ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। বাংলাদেশের শেষ ব্যাটার হিসেবে খালেদ আহমেদের উইকেটটি নেন রবীন্দ্র জাদেজা। নিজের বলে নিজে ক্যাচ নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করলেন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
জবাব দিতে নেমে ভারতের দুই ওপেনার যশস্বী জয়সোয়াল ও রোহিত শর্মা শুরু থেকেই চড়াও হন বাংলাদেশের দুই পেসার হাসান মাহমুদ ও খালেদ আহমেদের ওপর। তবে বড় ঝড়টা বয়ে যায় হাসানের ওপর দিয়েই। তার করা প্রথম ওভারেই তিন চারে ১২ রান নেন জয়সোয়াল।
পরের ওভারে খালেদ আহমেদের বলে দুই ছক্কা মারেন রোহিত। ওভারে আসে ১৭ রান। ভারতের দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় দুই ওভারে ২৯ রান। হাসানের পরের ওভারে রোহিত ও জয়সোয়াল মিলে নেন ২২ রান। আর তাতেই তিন ওভারে ৫০ পেরিয়ে যায় ভারতের সংগ্রহ।
এটিই টেস্টে দ্রুততম দলীয় ফিফটি। এর আগে ট্রেন্টব্রিজে এ বছরের শুরুর দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪.২ ওভারে দলীয় ফিফটি করেছিল ইংল্যান্ড। ৫ বা তার কম ওভারে দলীয় ফিফটির আরও দুটি কীর্তি আছে ইংল্যান্ডের। ১৯৯৪ সালে ৪.৩ ওভারে এবং ২০০২ সালে ৫ ওভারে দলীয় ফিফটি ছুঁয়েছিল তারা।
এদিকে রোহিত মাঝে একবার জীবন পেয়েছিলেন। তৃতীয় ওভারে হাসানের বল তার ব্যাটের গোড়ার অংশে লেগে উইকেটকিপারের গ্লাভসে ধরা পড়েছিল। কিন্তু রিভিও নেয়নি বাংলাদেশ। রিপ্লেতে স্পষ্ট দেখা গেছে বল তার ব্যাটে লেগেছিল। অবশ্য রোহিত এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি।
চতুর্থ ওভারে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে এলবিডব্লিউর আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। পরের বলেই ভারতীয় ওপেনারকে বোল্ড করেছেন বাংলাদেশের স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ। ১১ বলে ২৩ রান করেছেন রোহিত। তবে এরপর উইকেটে জেঁকে বসেন জয়সোয়াল।
জয়সোয়ালের ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুটেছে আজ। মাত্র ৩১ বলে তুলে নিয়েছেন ফিফটিও। যা ভারতের জার্সিতে টেস্টে যৌথভাবে তৃতীয় দ্রুততম ফিফটি। ১০ম ওভারে মিরাজের বলে ছক্কা হাঁকান জয়সোয়াল। এটি ভারতের চলতি বছরে ৯০তম ছক্কা। এক বছরে এর চেয়ে বেশি ছক্কা আর কোনো দলের নেই। ২০২২ সালে ৮৯ ছক্কা মেরে শীর্ষে উঠেছিল ইংল্যান্ড। আজ তাদের দুইয়ে নামালো ভারত।
দুজনের ব্যাটে ১০.১ ওভারে ১০০ পার হয় ভারতের। এটিও একটি রেকর্ড। এর আগে ২০২৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিপক্ষে ১২.২ ওভারে ১০০ করেছিল ভারত। সেটিই ছিল এত দিন দ্রুততম দলীয় সেঞ্চুরি। একইভাবে দেড় শ রানের রেকর্ডেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ মুক্তি পেয়েছে। ১২৭ বলে তাদের বিপক্ষে দ্রুততম ১৫০ রানের রেকর্ড গড়েছিল ভারত। এবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ১১০ বলে দেড় শ রান করে নতুন রেকর্ড গড়েছে ভারত।
এত দিন ২০০ রানের রেকর্ডের মালিক ছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬৯ বলে সিডনিতে করেছিল তারা। এবার তাদের সেই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছে ভারত। ১৪৮ বলে দ্রুততম ২০০ রানের রেকর্ড গড়েছে ভারত। বাদ যায়নি দ্রুততম ২৫০ রানের কীর্তিও। ২০২২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্রুততম আড়াই শর রেকর্ড গড়েছিল ইংল্যান্ড। ২০৪ বলে করা তাদের সেই রেকর্ড আজ ২১ বল বাকি থাকতেই ভেঙেছে ভারত। ১৮৩ বলে দ্রুততম ২৫০ রানের কীর্তি গড়েছেন রোহিত-বিরাট কোহলিরা।
জয়সোয়ালকে অবশ্য সেঞ্চুরি করতে দেননি হাসান মাহমুদ। ১৫তম ওভারে তাকে বোল্ড করে ফেরান বাংলাদেশের ডানহাতি পেসার। ৫১ বলে ৭২ রান করেছেন জয়সোয়াল। এরপর বোলিংয়ে এসে আগ্রাসী রূপ ধারণ করা গিলকে বিদায় করেন সাকিব। ৩৬ বলে ৩৯ রান করা গিল তুলতে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন হাসানের হাতে।
ভারতকে চতুর্থ ধাক্কাটাও দেন সাকিব। নিজের পরবর্তী ওভারেই তিনি বিদায় করেন বিধ্বংসী ব্যাটার ঋষভ পন্থকে। ১১ বলে স্রেফ ৯ রান করে পন্থও ক্যাচ দেন হাসানের হাতেই। এরপর জুটি গড়েন বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। রাহুল ফিফটি তুলে নিলেও ৩ রান দূরে থামেন কোহলি। ৩৫ বলে ৪৭ রান করা কোহলি সাকিবের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন।
ভারতকে পরের আঘাতটি করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ক্রিজে সেট হওয়ার আগেই রবীন্দ্র জাদেজাকে (৮) বিদায় করেন তিনি। চাপে পড়ে যাওয়া ভারতকে আরও একবার ধাক্কা দেন সাকিব। ৩৪তম ওভারে তিনি ফেরান রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান অশ্বিন আজ ১ রান করেই বোল্ড হয়ে ফিরেছেন।
পরের ওভারেই ভারতের শেষ ভরসা রাহুলকে বিদায় করেন মিরাজ। ৪৩ বলে ৬৮ রান করা এই ব্যাটার পড়েন স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে। এরপর আকাশ দীপকেও (১২) তুলে নেন মিরাজ। এরপরেই ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। ৩৪.২ ওভারে তাদের সংগ্রহ তখন ৯ উইকেটে ২৮৫ রান। লিড ৫২ রানের। বল হাতে সাকিব ও মিরাজ দুজনেই পান ৪টি করে উইকেট।
এরপর নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ৭ ওভারে নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেন দুই ওপেনার সাদমান ইসলাম ও জাকির হাসান। কিন্তু অষ্টম ওভারের প্রথম বলেই জাকির (১০) বিদায় নেন ভারতীয় স্পিনার অশ্বিনের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে। নাইটওয়াচম্যান হিসেবে তিনে নামা হাসান মাহমুদ টিকতে পারেন ৯ বল। ৪ রান করে তিনিও শিকার হন অশ্বিনের।
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪
এমএইচএম