ঢাকা: বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলাকালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ঘটে যাওয়া অনিয়মের প্রতিবাদে গত ০১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অনিয়ম ও বিতর্কিত বেশকিছু ঘটনার সঙ্গে জড়িত আইসিসির চেয়ারম্যান শ্রী নিবাসনের সঙ্গেই ছিলো মুস্তফা কামালের মূল দ্বন্দ্ব।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের আমন্ত্রণে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ফাইনাল ম্যাচটি দেখতে কলকাতায় গিয়েছিলেন তিনি। দেশে ফিরে বুধবার (২৭ মে) সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইসিসির সাবেক এই সভাপতি। গণমাধ্যমের সঙ্গে মুস্তফা কামালের প্রশ্নোত্তর পর্বটি বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: আপনার আইপিএল ফাইনাল দেখতে যাওয়া একটু চমকের মতোই। যেমন পরিবেশ ছিল তাতে এমনটা অনেকেই আশা করেননি। এই সফর সম্পর্কে জানতে চাই।
মুস্তফা কামাল: ভারতের ক্রিকেটের অবকাঠামো নিয়ে আমি কিছু বলিনি, তাদের কোনো খেলোয়াড় সম্পর্কেও বলিনি। ভারত সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করিনি। আমি মন্তব্য করেছি একজন মানুষ সম্পর্কে। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। তিনি আইসিসির চেয়ারম্যান। তার সম্পর্কেই মন্তব্য করেছি গত কয়েকদিন ধরে। আমি তো ক্রিকেটভক্ত একজন মানুষ। আমার সঙ্গে যদি ভারতের সম্পর্ক খারাপ হতো তাহলে আমি যেতাম না। আমার সঙ্গে তো ভারতের খারাপ সম্পর্ক নেই।
প্রশ্ন: আইসিসি চেয়ারম্যান শ্রীনিবাসন তো বিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি হয়েই আইসিসিতে আছেন। তার বিপক্ষে কথা বলতে গেলে সেখানে ভারতীয় বোর্ডও সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে।
মুস্তফা কামাল: এখন তিনি ভারতীয় ক্রকিটে বোর্ডের কেউ না। আইসিসির সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমি আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের কেউ ছিলাম না। আমার নাম যখন গেছে তখন আমি ক্রিকেট বোর্ডের কিছু ছিলাম। যখন আমি সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গেলাম, তখন নিয়মটা ছিল ৭ দিনের ভেতর বিসিবির পদ ছাড়তে হবে। তখন থেকে আমি আর কেউ না ক্রিকেট বোর্ডের। তিনিও (শ্রী নিবাসন) ভারতীয় ক্রিকেটর বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের কেউ না। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আর আইসিসি দুটি আলাদা সত্তা।
আমাদের সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। মাঝে তিনি কিছুদিন বোর্ডের সভাপতি ছিলেন, তখন সর্ম্পক কিছুটা খারাপ ছিল। তিনি আমাদের বিভিন্ন সময় বিপদে ফেলেছেন। তিনি আইসিসিতে আসার পর অনেক নতুন নতুন আইন করেছেন। সে সমস্ত বিষয়ের কিছু কিছু আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। সেগুলো তিনিই করেছেন। কেন করেছেন, তা আমি জানি না।
প্রশ্ন: ভারতরে সঙ্গে এখন বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন?
মুস্তফা কামাল: ভারতের সঙ্গে ক্রিকেটের স্বার্থে আগা-গোড়াই আমাদরে ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের ক্রিকেটের প্রাথমিক স্টেজে জগমোহন ডালমিয়া আইসিসির সভাপতি ছিলেন। তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা অসাধারণ। ডালমিয়া নিজ দেশের জন্য যে ভূমিকা রাখতেন সেটা আমাদের জন্যও রেখেছেন। এজন্য তিনি আমাদের অভিভাবক। তিনি এখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি। তাহলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে কেন?
প্রশ্ন: পুরো সফরটা আপনি কতটা উপভোগ করেছেন?
মুস্তফা কামাল: আইপিএল ফাইনাল আমি প্রতি বছরই দেখি। এজন্য দেখতে গিয়েছি। খুব কাছে ছিল, কলকাতায়। যদি চেন্নাই হতো তাহলে হয়তো যেতাম না (হাসি)।
ওখানে (আইপিএল দেখতে ভারতে) গেলাম। কারণ ক্রিকেটে আমাদের উন্নতি করতে হবে। সেজন্য ভারতের সাহায্য লাগবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। আগে এখানে তাদের যে বিনিয়োগ হত, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। ফলে রাজনতৈকি পরিস্থিতির সঙ্গে ক্রিকেটীয় ব্যাপারগুলোও ঠিক রাখা দরকার। আমি সেখানে না গেলেও কিছু হতো না, মূল উদ্দেশ্য ছিলো খেলা দেখা এবং তাদের সন্দেহ দূর করা। তারা ভেবেছে ভারতীয় দল বাংলাদেশে এলে আমরা তাদের ভালোভাবে বরণ করবো না। আমি তাদের বুঝিয়েছি, এটা ভুল। আমাদের দেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলা দেখতে চায়। বলেছি, বিসিসিআই শক্তিশালী দল পাঠাবে না শুনে আমরা মন খারাপ করেছিলাম। কিন্তু শক্তিশালী দলই যখন পাঠানো হচ্ছে তখন সব ঠিক আছে।
আমি যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলাম। তখনও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি পাকিস্তান, শ্রীলংকার সঙ্গেও ছিল। আমি সব সময় আমাদের এশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়নে জোর দিয়েছি।
প্রশ্ন: ভারতীয় বোর্ডের ছায়া সরে যাচ্ছে শ্রীনির ওপর থেকে। সেটা কি ভবিষ্যতে আইসিসিতেও প্রভাব ফেলবে? মানে বিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি হয়ে আইসিসিতে তার থাকা হবে না?
মুস্তফা কামাল: শ্রীনির বিষয়ে আমি যা বলার বলে দিয়েছি। তার সম্পর্কে বা আইসিসি সম্পর্কে আমি আর কিছু বলবো না। আমি বিসিসিআই’র কেউ নই বা আইসিসিরও কেউ নই। তার বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। একজন খারাপ হলে আমিও খারাপ হব নাকি? একটা লোক খারাপ হলে কতোবার বলতে হবে যে সে খারাপ! আর কত বার আপনারা আমাকে দিয়ে ওকে খারাপ বলাবেন?
ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকা আমাকে প্রশ্ন করেছিলো শ্রীনির ওপরে আমি কতটা ক্ষিপ্ত, আমি শ্রীনিকে ফোন করেছি কিনা তারা জানতে চেয়েছে। জবাবে বলেছি, ‘আমার তরফ থেকে ফোন করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না’। ওরা জানতে চেয়েছে শ্রীনি ফোন করলে আমি ক্ষমা করবো কিনা। আমি বলেছি, ‘নিশ্চয়ই। তিনি ফোন করলে আমি ক্ষমা কেন করবো না? অবশ্যই ক্ষমা করবো। ’ এটা বলায় তারা অনেক খুশি হয়েছে।
আমি কেবল চেষ্টা করেছি এটা বোঝাতে যে, ভারতীয় বোর্ড ও বাংলাদেশ বোর্ডের সম্পর্ক স্বাভাবিক। আইপিএলে যিনি ছিলেন (রাজিব শুক্লা), তিনি আমার এক পাশে ছিলেন এবং পাপন সাহেবও (নাজমুল হাসান পাপন) ছিলেন। এ ছাড়া বিসিসিআইয়ের জেনারেল সেক্রেটারি অনুরাগ ঠাকুর আমার একপাশে ছিলেন। ভারত যাওয়ার সময় পাপন সাহেবকে আমি নিয়ে গেছি। তাদের বোঝানোর জন্য যে ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক আছে। ডালমিয়া নিজে বলেছেন, এখন তো সাহসী লোকের অভাব। তবে এখানে একজন সাহসী মানুষ আছে। তিনি মুস্তফা কামাল। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী মানুষ।
আমি তাদের এটাও বলেছি ভারতীয় দলের আপত্তি না থাকলে তাদের সম্মানে আমি আমার বাড়িতে ডিনারের আয়োজন করবো। তাদের মনে যেন কোনো ভয়ভীতি কাজ না করে। আমরা তাদের আক্রমণ করার মতো নই। আমাদের মানসিকতা কখনো সে রকম নয়। আমরা জানি আমরা কিভাবে এখানে আসলাম। আমরা তো ক্রিকেট এলাকারই মানুষ। আমার মনে হয় এখন সবাই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
পদত্যাগের পর সবাই আমার পক্ষে চলে এসেছে। অথচ পদত্যাগের পর দেশের মানুষ আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবে তা নিয়ে শঙ্কা ছিলো। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। জায়ান্ট স্ক্রিনে ভারতের পক্ষ নেওয়া নিয়ে আমি যে প্রতিবাদ করেছি, তা কিন্তু কাজে লেগেছে। পরের ম্যাচে (ভারত-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল) আর সেটা ছিলো না। অন্য কথা ছিলো। জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা ছিলো ‘কাপের সঙ্গে থাকো’ মানে দুই দলের পক্ষ নিয়েই স্লোগান ছিলো সেখানে। এ ছাড়া যাদের বিষয়ে আমার অভিযোগ ছিলো তাদের আর মাঠে দেখা যায়নি। ক্যামেরা ও প্রযুক্তির ব্যবহারও হয়েছে পরের ম্যাচ থেকে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে কিভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চান?
মুস্তফা কামাল: ক্রকিটে আমার ভালো লাগার জায়গা। মনের তৃপ্তির জন্য কাজ করাটাই বড়। আমি তাই ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকবো। যে কোনোভাবে থাকবো। আমি এর মধ্যেই একজনকে আমাদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে জরিপ করিয়েছি। প্রতিটি গ্রামে কিভাবে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা দেখার জন্য তিনি কাজ করছেন।
ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলা ছড়িয়ে দিতে হবে। তাতে জয়ের আকাঙ্ক্ষা থাকবে। প্রতিটি স্কুলে দুটি করে দল থাকবে। ক্লাস সেভেন আর নাইন এক দল এবং ক্লাস এইট এবং ক্লাস টেন মিলে একটা দল; এভাবে দুটি করে দল হয়ে স্কুলে সব সময় খেলা হবে। পরে ইউনিয়ন পর্যায়ে স্কুল ক্রিকেট হবে। তারপর থানা পর্যায়ে আসবে। এভাবে কোনো ক্রিকেটার বেরিয়ে এলে, সফলতা দেখা দিলে আমি সারা বাংলাদেশে এটা ছড়িয়ে দেবো। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এটা করবো। বিপিএল আমি শুরু করেছিলাম, এবার আবার সেটা আয়োজিত হবে। আমি বিপিএলের সঙ্গে থাকবো। সিলেট রয়্যালসের সঙ্গে আমার মেয়ে আছে। আমি এটার অনারারি চেয়ারম্যান হিসেবে থাকবো। এতে আমার সম্পৃক্ততা থাকবে।
বাংলাদশে সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫
এসকে/এমজেএফ