ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

ক্রিকেট

এখনও ক্লান্ত নন মাশরাফি

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৮
এখনও ক্লান্ত নন মাশরাফি মাশরাফি বিন মর্তুজা। ছবি: শোয়েব মিথুন

মাশরাফিকে দেখলেই পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীনের ‘ফুটবল খেলোয়াড়’ কবিতাটি মনে পড়ে যায়। ‘হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে’ বিক্ষত ইমদাদ হককে নিয়ে শঙ্কিত কবি লিখেছিলেন- “আমরা তো ভাবি ছমাসের তরে পঙ্গু সে হল হায়,/ ফুটবল-টিমে বল লয়ে কভু দেখিতে পাব না তায়।”

ব্যথা জয় করে ফের যখন মাঠে ফিরে ইমদাদ হক গোল করেন তখন গৌরবের সঙ্গে কবি বলেন, “গোল-গোল-গোল মোদের মেসের ইমদাদ হক কাজি, ভাঙা দুটি পায়ে জয়ের ভাগ্য লুটিয়া আনিলো আজি। ”

ইনজুরিতে পড়ে মাশরাফির হাঁটুতে যখন অস্ত্রোপচার হয় সবাই হয়তো ভাবেন তিনি আর মাঠে ফিরবেন না।

সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে প্রতিবারই অস্ত্রোপচার শেষে মাঠে ফিরে দেশকে জয় উপহার দিয়েছেন মাশরাফি। ১৬ কোটি মানুষকে ভাসিয়েছেন আনন্দের বন্যায়।

বয়স পয়ত্রিশের দিকে ছুটছে নড়াইল এক্সপ্রেসের। এখনও কি মারণঘাতী তার এক-একটি ডেলিভারি! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পাশাপাশি বোলিংয়ের বিষ ছড়াচ্ছেন ঘরোয়া ক্রিকেটেও। চলতি মৌসুমে ১৪ ম্যাচে ৩৫ উইকেট শিকার করে ধরে ফেলেছেন লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এক মৌসুমের সর্বোচ্চ শিকারি আবু হায়দার রনিকে।

মাত্র একটি উইকেট হলেই আরেকটি ইতিহাস গড়বেন মাশরাফি। এতে অবশ্য আহ্লাদিত নন মোটেও। এমন ক্ষুরধার পারফরম্যান্স ধারাবাহিকভাবে করে যেতে চান দেশসেরা এই পেসার। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারেও ক্লান্ত নন অভিজ্ঞ এই যোদ্ধা।

বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে সেসব কথাই জানালেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিনবদলের এই সেনাপতি। পাঠকদের জন্য সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো।

বাংলানিউজ: এ বছর অধিকাংশ সিরিজই দেশের বাইরে। ভালো করা কতটা চ্যালেঞ্জিং?

মাশরাফি: অনেক চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে বাইরের সিরিজ আমাদের জন্য সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। দেশে এ পর্যন্ত ভাল খেলেছি। যদিও ট্রাইনেশন জিততে পারিনি। তার মানে এই না হোমে আমরা ভালো খেলছি না। দেশের বাইরে সিরিজ বিশ্বকাপের জন্য ভালো প্রস্তুতি বলতে পারেন।

বাংলানিউজ: দেশের বাইরে সিরিজ জয় আর কতদিন চ্যালেঞ্জিং থাকবে? 

মাশরাফি: বাংলাদেশ ক্রিকেট তো এখন অনেক পরিণত। আপনি যদি দেশের বাইরে আমাদের পারফরম্যান্স দেখেন, দেখবেন বড় দলের চাইতে আমাদের পারফরম্যান্স আলাদা করা কঠিন। দেখবেন দক্ষিণ আফ্রিকাও যদি এখন ভারতে খেলতে আসে ৪-০ তে হারে। ওরা কিন্তু বিশ্বের এক নম্বর দল। খেলাটাই এখন হোম-অ্যাওয়ে হয়ে গেছে। অন্য দেশে খেলাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। তেমনি অন্য দেশেরও বাংলাদেশে এসে ভালো করাটা কঠিন হয়ে গেছে।

বাংলানিউজ: দেশসেরা পেসার আপনি। এ বিষয়টি আপনাকে কতটুকু আলোড়িত করে? 

মাশরাফি: চ্যালেঞ্জের কথা বললেন, এটা তো নিজের কাছে নিজেরই চ্যালেঞ্জ। শুধু খেলার জন্য খেলে গেলো তো হবে না, আমাকে পারফর্ম করে খেলতে হবে। আমার জায়গায় আমি পারফর্ম করার চেষ্টা করছি। কখনও হবে, কখনও হবে না। তবে চেষ্টা করি ধারাবাহিক পারফর্ম করার। যতদিন খেলবো চেষ্টা করবো।
কোর্টনি ওয়ালশের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মাশরাফি।  ছবি: শোয়েব মিথুনবাংলানিউজ: বাংলাদেশ দলের তরুণ পেসারদের লাইন-লেন্থের সমস্যা দীর্ঘদিনের। আশু সমাধান হবে কি?

মাশরাফি: একটা ছেলের বয়স ২০-২২ হলে তাকে তরুণই বলতে হবে, সে যতদিনই খেলুক। সবার কাছে তাড়াতাড়ি প্রত্যাশা করাও ঠিক না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এক দুই দিনের ব্যাপার না যে, আপনি যাবেন আর পারফর্ম করবেন। তাসকিন-মোস্তাফিজ, এরা এখনও তরুণ। ওদের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া পর্যন্ত প্রত্যাশা করতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, ওদের এখন থেকেই তৈরি করে তুলতে হবে।

বাংলানিউজ: কোর্টনি ওয়ালশের মতো একজন কোচ থাকতেও পেসাররা ভালো করতে পারছে না। আসলে সমস্যাটা কোথায়? তিনি কি সঠিক নির্দেশনা দিতে পারছেন না নাকি আমাদের ছেলেরা নিতে পারছে না?

মাশরাফি: টেস্টে অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের একটা বড় গ্যাপ আছে। মিচেল স্টার্ক বা প্যাট কামিন্স টেস্টে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিচ্ছে। যদি ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি দেখেন তবে স্টার্ক ও কামিন্সের সাথে আমাদের মোস্তাফিজ-রুবেলের পার্থক্যটা কতটুকু? বেশি গ্যাপ নাই। তারাও ১০ ওভারে ৭০ রান দিচ্ছে নিজেদের কন্ডিশনে খেলেও। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড ৩৩০ রান করছে। এই রান টপকেও যাচ্ছে। এখন সারা বিশ্বে ব্যাটসম্যানদের অধীনেই খেলা চলে। বিশ্ব ক্রিকেট কিন্তু এখন ব্যাটিংয়ের ওপরেই চলছে। তবে এটা ঠিক টেস্টে আমাদের যে গ্যাপ তাতে উন্নতি দরকার। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে আমরা সামনের দিকে যাচ্ছি। সামনে আরও ভালো করবো।

বাংলানিউজ: বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ তিনটি সিরিজ খেললো। আপনার চোখে কেমন ছিল?

মাশরাফি: ভালো খেলেছি, খারাপও খেলেছি। হোম সিরিজে বেশিরভাগ ম্যাচই হেরেছি। নিদাহাস ট্রফিতে আবার দল ভালো খেলেছে। তবে পজিটিভ দিক হচ্ছে নিদাহাস ট্রফিটা যেহেতু আমাদের দেশে খেলা হয়নি, ওদের দেশে গিয়ে ভালো খেলেছি।

বাংলানিউজ: আর একটি উইকেট হলেই লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে এক মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হবেন। কতটুকু উচ্ছ্বসিত?

মাশরাফি: এসব নিয়ে আমার বাড়তি কোন উৎসাহ কাজ করে না। এটা আমি মনেই রাখি না।

বাংলানিউজ: হেড কোচ খুঁজছে বিসিবি। কেমন প্রত্যাশা করছেন? হাতুরুসিংহের মতো কঠিন কাউকে নাকি কিছুটা নরম কোচ চান?

মাশরাফি: জাতীয় দলের কোচ হলে তো কঠিন হবেই। এটা স্বাভাবিক। আগে  বাংলাদেশের কোচ যারা ছিলেন সবাই কঠিন স্বভাবের। তবে কোচ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কেননা যিনিই কোচ হবেন নিজের প্রোফাইলের জন্য তিনি ভালো করতে চাইবেন।

বাংলানিউজ: কোচ খুঁজতে গিয়ে সময়টা কি বেশি নিয়ে ফেললো বিসিবি?
মহিবুর হিল্লোলের সঙ্গে আলাপচারিতায় মাশরাফি।  ছবি: শোয়েব মিথুনমাশরাফি: আন্দাজে তো একটা কোচ সেট করা যায় না। সামনে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। অনেক টেস্ট ম্যাচ, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আছে। হুট করে কাউকে এনেই তো ছয়মাস পরে বলতে পারবেন না চলে যাও। ভেবেচিন্তে সুযোগ বুঝে একটা ভালো কোচ আনতে হবে। ভালো কোচের জন্য বিসিবি চেষ্টা করছে। যারা আছে তারা আইপিএল, সিপিএল, পিএসএলে কোচিং করাচ্ছে। চাইলেই কোয়ালিটি কোচ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন না যে, টাকা বাড়িয়ে দিলে হচ্ছে। সবার পরিবার আছে। স্বল্প সময়ের কাজ করে পরিবারকে সময় দিতে পারে। কোচ খোঁজার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক জায়গাটা এখন কঠিন হয়ে গেছে।

বাংলানিউজ: ডেভিড ইয়াং বলেছেন আপনার পায়ের বর্তমান অবস্থায় টেস্ট ম্যাচ খেলা
যাবে। আপনি কতটুকু প্রস্তুত?

মাশরাফি: টেস্ট খেলার জন্য ফিট মানে তিনি আমার শারিরীক অবস্থা মানে পায়ের বিষয়টিকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু আমাকে তো সেজন্য তৈরি হতে হবে। বললেই তো আর হবে না। টেস্ট এত সহজ খেলা না। আমাকে সময় দিতে হবে। যেহেতু সামনে বিশ্বকাপসহ আরও অনেক খেলা আছে। আমার ফোকাসও আছে ওই পর্যন্ত যাওয়ার। আমি এখনও রেডি না। তাই এসব কথা বলা ঠিক না।

বাংলানিউজ: আপনি নাকি বিসিবিকে টেস্ট খেলার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন?

মাশরাফি: না এমন কোনো কথা বলিনি। আমি বলেছিলাম যেহেতু আমি টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়েছি তো ওর চাইতে আমার টেস্ট খেলাই ভালো। টি-টোয়েন্টিতে আবার ফেরত আসা প্রসঙ্গে প্রেস কনফারেন্সে আমি একথা বলেছিলাম। কিন্তু খেলার জন্য আমাকে ওই পরিমাণ ফিট হতে হবে, ওই পরিমাণ বোলিং করতে হবে। সেজন্য একটা প্রস্তুতি দরকার যেটা হওয়তো আমার নেই। সামনে কী হবে দেখা যাক।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশ কেন মানসম্মত লেগ স্পিনার পাচ্ছে না?

মাশরাফি: তরুণ যারা উঠে আসছে তারা লেগস্পিনটাকে গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছে না। লেগ স্পিন যে একটা আলাদা শিল্প, এটা হয়তো আমরা তাদের বোঝাতে পারিনি। অথবা তারা যেসব জায়গা থেকে উঠে আসছে হয়তো সাকিব নয় মোস্তাফিজ কিংবা তামিমকে দেখে বড় হচ্ছে। আমাদের তো লেগ স্পিনারদের দিয়ে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়নি। তাই ওরা বিষয়টি জানেও না। কিন্তু এখন তো তৃণমূল পর্যায় থেকে খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। লেগ স্পিনারদের একটা ক্যাম্পও হয়েছে। ১০-১২ জন প্লেয়ার পাওয়া গেছে। এখান থেকে যদি বের হয়ে আসে।

বাংলানিউজ: বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন বাংলাদেশে মাশরাফির বিকল্প নেই। বোর্ড প্রধানের মুখ থেকে এমন প্রশংসা কতটুকু অনুপ্রাণিত করে?

মাশরাফি: অবশ্যই ভালো লাগে, না লাগার কিছু নেই। এটা এক ধরনের প্রেরণা। যখন আপনার প্রতি কারও আস্থা থাকবে আপনি অবশ্যই চাইবেন ভালো কিছু করতে। এমন কথা শুনলে চেষ্টার মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়!

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৮
এইচএল/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।