চট্টগ্রাম: অন্যদের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার কথা ছিল মেয়েটার। কিন্তু সহজে নির্ণয় না হওয়া রোগ ‘লুপাস’ কেড়ে নিয়েছে তাঁর স্বপ্ন।
শুক্রবার (৯ মে) কথা হয় লুপাস আক্রান্ত সৈয়দা মারিয়া আফেন্দি প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৪ সালে তিনি অস্টিওনেক্রোসিসে (হাড়ের টিস্যু নষ্ট হয়ে যাওয়া) আক্রান্ত হন। ফলে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কোমর ও হাঁটুর হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে। হাতে তুলে নিতে হয় ক্রাচ। ২০১৭ সালে আক্রান্ত হয় কিডনি। ওই সময়েই বিয়ে হয় এক ডাক্তারের সঙ্গে। কিন্তু সংসারটা টিকেনি। ডিভোর্স হয়ে যায় ২০১৯ সালে।
৩১ বছরের প্রিয়াঙ্কা বাবার ব্যবসার কারণে আগে শহরেই থাকতেন। এখন থাকেন গ্রামের বাড়ি চকরিয়ায়। তিনি বলেন, ‘লুপাস রোগের চিকিৎসায় প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। চেকআপ করাতে গেলে লাগে ২০-২৫ হাজার। ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি। তবে হাঁটুর ব্যথা খুব কষ্ট দিচ্ছে। চিন্তায় আছি কিডনি নিয়েও। লুপাসের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। এই রোগে আক্রান্তদের জন্য সরকার যদি আলাদা তহবিল গঠন করে দেয়, তবে রোগীরা উপকৃত হবে’।
লুপাস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের সদস্য সৈয়দা মারিয়া আফেন্দি প্রিয়াঙ্কার ‘map_s_lupus’ নামের একটি ফেসবুক পেজ আছে। আক্রান্তরা কীভাবে এই রোগ মোকাবিলা করবেন, সে বিষয়ে সচেতন করছেন তিনি।
লুপাস ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে ২-৫ লাখ লুপাস রোগী রয়েছে। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। অনেকেই আছেন চিকিৎসার বাইরে। আক্রান্ত ৮৭ শতাংশ রোগীর শরীরের একটি অঙ্গ দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬০ শতাংশ রোগীর ত্বক, ৪৫ শতাংশের হাড়-পেশি ও সন্ধি এবং ৩৬ শতাংশের কিডনির ক্ষতি হয়।
রোগটার পুরো নাম সিস্টেমিক লুপাস অ্যারিথেমাটোসাস (এসএলই)। এটি ক্রনিক অটো-ইমিউন রোগ। ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। নারী ও পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার অনুপাত ৯ : ১। শিশুদেরও হতে পারে এই জটিল রোগ। গবেষকদের ধারণা, রোগটির সঙ্গে সেক্স হরমোনের সম্পর্ক থাকতে পারে। এছাড়া বংশগত ও পরিবেশগত প্রভাব, ভাইরাস সংক্রমণ রোগের বিস্তার ঘটায়। একবার আক্রান্ত হলে শেষ পর্যন্ত ওষুধ খেয়েই যেতে হয় বলে জানালেন চিকিৎসকরা।
রিউম্যাটোলজিস্ট ডা. রওশন আরা জানান, লুপাস বা এসএলই রোগটি সচরাচর দেখা না গেলেও বিরল নয়। হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এতে দেহের ত্বক, মাংসপেশি, স্নায়ু, হৃৎপিণ্ড, কিডনিসহ প্রায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়। এই রোগে দেহের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা, ত্বকে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি, নাকের দুই পাশে ও গালে প্রজাপতির ডানার মতো বিস্তৃত লাল দানা, মুখের তালুতে ঘা, চুল পড়া, জ্বর, হাত-পা ফোলা, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, অসংলগ্ন আচরণ, রক্তশূন্যতা ও রক্তকণিকা কমে যাওয়া, পেট-বুকে পানি জমাসহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা নিলে ভালো থাকা যায়। তবে সমস্যা হলো, সহজে রোগটা নির্ণয় হয় না।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রিউম্যাটোলজি বিভাগ ও জেনারেল হাসপাতালে ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে গত এক বছরে কতজন এই রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ব্যক্তিগত চেম্বারে রিউম্যাটোলজিস্টরা মাঝে-মধ্যে এরকম রোগী পান, যারা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকামুখি হয়েছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লুপাস আক্রান্ত আরেকজন নারী জানান, ১৮ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি এ রোগে আক্রান্ত হন। চট্টগ্রামে কয়েকজন ডাক্তার দেখিয়েও রোগ শনাক্ত না হওয়ায় ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষার পর তিনি লুপাসের কথা প্রথম জানতে পারেন। খিঁচুনি থাকায় তাঁর মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়েছে। সেই থেকে চলছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ।
বাংলাদেশ চাইল্ড রিউম্যাটোলজি সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, ছোটদের ক্ষেত্রে লুপাস সাধারণত ১১-১২ বছর বয়সে হতে পারে। তবে ৫ বছরের নিচে এটি কম হতে দেখা যায়। বিশ্বে লুপাসে আক্রান্ত মোট রোগীর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শিশু। এর মধ্যে মেয়েশিশু বেশি। লুপাস আক্রান্ত শিশুর ঘন ঘন জ্বর হয়, ক্ষুধামান্দ্য ও অস্থিরতায় ভোগে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিশুর মস্তিষ্ক, রক্তকোষ, কিডনি, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গ আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. প্রণব কুমার চৌধুরীর মতে, ‘গর্ভবতী মা যদি লুপাস অসুখে ভোগেন তবে বার বার গর্ভপাত, গর্ভের সন্তানের কম বাড়ন, মায়ের প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রিটার্ম নবজাতক সন্তান জন্ম নেওয়ার মত নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। কখনো এসব মায়ের নবজাতক সন্তানেও লুপাস দেখা যায়। যেখানে নবজাতকের শরীরে র্যাশ ও কদাচিৎ হার্ট ব্লকের মত বিপত্তি দেখা দিতে পারে’।
রিউম্যাটোলজিস্টরা বলছেন, চামড়ায় র্যাশ বা পরিবর্তন দেখে অনেকে চর্মরোগ ভেবে ভুল করেন। প্রথমে রক্তের পরীক্ষা, এরপর প্রস্রাব পরীক্ষা ও কিডনির বায়োপ্সি করা হয়। এই রিপোর্ট দেখে লুপাস কোন পর্যায়ে রয়েছে তা বুঝা যায়। আধুনিক চিকিৎসায় ‘চিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর-টি সেল থেরাপি’ দিয়ে কোষকে জিনগতভাবে পরিবর্তন করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এ রোগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন কমানো, সুষম খাদ্য গ্রহণ, দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, মে ০৯, ২০২৫
এসি/টিসি