একাত্তরের স্মৃতিচারণ করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ (মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত) নিয়ে ১ নম্বর সেক্টর গড়ে উঠেছিল, যার কমান্ডার ছিলেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স মাঠে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের মাধ্যমে সারাদেশে যুদ্ধ থেমে গেলেও ১ নম্বর সেক্টর চট্টগ্রামে তখনো যুদ্ধ চলছিল।
‘৭ ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত করার পর যৌথবাহিনী চট্টগ্রাম দখলের উদ্দেশে শুভপুর থেকে দুইভাগ হয়ে অগ্রসর হয়। একটি অংশ ফটিকছড়ির নারায়ণহাট, দাঁতমারা, হেঁয়াকো প্রভৃতি এলাকায় যুদ্ধ করতে করতে হাটহাজারীর দিকে আসতে থাকে।
তিনি বলেন, ৩০ মার্চের আগে কিছু ছেলে সংগঠিত হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ‘বগাপা’ নামক স্থানে বিএসএফের কাছে সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং নিয়েছিল। তারা ফেরার পথেই আমার প্রবেশ। এরপর ১ সপ্তাহের প্রশিক্ষণে আমি ভালো করেছি। এর মধ্যে যারা সাহসী, উদ্যমী, ত্যাগী তাদের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়। আমিও মনোনীত হলাম। সঙ্গে ছিলেন সীতাকুণ্ডের সাবেক পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ, রাঙ্গুনিয়ার আবুল কাশেম চিশতি, কর্ণফুলী নদীতে নৌ কমান্ডোর ডেপুটি কমান্ডার ডা. শাহ আলম বীর উত্তম, সম্ভবত ঘাটফরহাদবেগের মাহবুবুল আলম (যিনি রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর হামলা করেন), ক্যাপ্টেন মঞ্জুরুল আলম বাবলু প্রমুখ।
‘এরপর আমাদের ভারতীয় মিলিটারির ‘অম্পিনগর’ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ১ মাস ৩ ইঞ্চি মর্টার, মিডিয়াম মেশিন গান (এমএমজি) চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে হরিণা ক্যাম্পে আসি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য লোক নিয়োগ চলছে। আমি অফিসার পদে প্রার্থী হলাম, ইন্টারভিউ দিলাম। টিকেও গেলাম। বাধ সাধলো উচ্চমাধ্যমিকের সার্টিফিকেট না থাকা। থাকবে কোত্থেকে, আমিতো পরীক্ষা দিইনি তখন! এরপর আসামের ‘হাফলং’ এলাকায় বিএলএফের প্রশিক্ষণ নিলাম। আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। ১ মাস পর যুদ্ধজয়ের নেশায় দেশে আসি বৈষ্ণবপুর সীমান্ত দিয়ে। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন পটিয়ার রশিদাবাদের নুরুল আনোয়ার (শহীদ)। সঙ্গে ছিলেন ইদ্রিস আনোয়ারী, চন্দনাইশের অজিতসহ সাতজন’।
‘যুদ্ধ করতে করতে আমরা পটিয়া আসি। আমি পটিয়া ও চন্দনাইশে বিএলএফ সংগঠিত করার দায়িত্ব নিই। একপর্যায়ে আনোয়ারায় থানা অপারেশনে অংশ নিই। এরপর গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিতে শহরে চলে আসি। ঈদের আগের দিন চন্দনপুরার প্যারেড মাঠের পাশের একটি রাজাকার ঘাঁটিতে অপারেশন পরিচালনা করি। আসা-যাওয়ার জন্য বিশ্বস্ত টেক্সিচালককে ভাড়া করে নিলাম। আমার সঙ্গে ছিল মাহবুব। তার দায়িত্ব ছিল দরজা খুলে ব্রাশফায়ার করার। আমি স্টেনগান হাতে জানালা থেকে তাকে কাভার দেব। কিন্তু দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে মাহবুব বিপত্তি বাধালো। রাজাকাররা ঘুরে দাঁড়াতেই আমি স্টেনগান দিয়ে ঝাঁঝরা করে দিলাম তাদের। আমরা দ্রুত টেক্সি নিয়ে আস্তানায় চলে যাই।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর মিরসরাই মুক্ত হয় এবং সেক্টর কমান্ডারের হেড কোয়ার্টার মিরসরাই নিয়ে আসা হয়। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ডে পাকিস্তানি প্রতিরোধ চূর্ণ করে বাংলাদেশ বাহিনী চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় কুমিল্লা-চাঁদপুর ফ্রন্টে লাকসাম এলাকামুক্ত করে ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর নেতৃত্বে ভারতের ৮৩ ব্রিগেড চট্টগ্রাম দখলের অভিযানে বাংলাদেশ বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মিত্রবাহিনী কুমিরায় পাকিস্তানিদের ডিফেন্সের সীমানায় পৌঁছে যায়। কুমিরায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি গভীর খালের ওপরে থাকা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানিরা ব্রিজের দক্ষিণে রাস্তার দুপাশে শক্তিশালী ডিফেন্স তৈরি করেছিল। রাস্তার পূর্বপাশে পাহাড়ের যক্ষ্মা হাসপাতালে তাদের ভারী মেশিনগান তাক করা ছিল। ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত এখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যৌথবাহিনীর তুমুল লড়াই চলে। ভোর ৩টায় যৌথবাহিনী কুমিরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়। ’
নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর ভাষায় ‘১৫ ডিসেম্বর কুমিরার দক্ষিণে পাকিস্তানিদের কতগুলো অস্থায়ী ডিফেন্স ভেঙে যৌথবাহিনী ভাটিয়ারিতে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রবল প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করেছিল। এখানে ১৬ ডিসেম্বর প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। পালানোর সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটিয়ারি অংশে তারা একটি সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। যে কারণে চট্টগ্রামের পথে আগুয়ান মুক্তিযোদ্ধা-স্বেচ্ছাসেবক ও ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা বিলম্বিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা রাত সেতুর পাশে খালের মধ্যে একটি বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়। এরপর বাংলাদেশ বাহিনী দ্রুত বিনাবাধায় চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে তারা। ১৭ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ’
আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, যুদ্ধকালীন একসময় আমি আশ্রয় নিই নজির আহমদ চৌধুরী সড়কের আ জ ম নাছির উদ্দীনের বাসায়। একরাতে রাজাকাররা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায় ডালিম হোটেলে। ওই হোটেলে রেখে আমাদের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। তারপরও মুখ খুলিনি আমি। দেশ স্বাধীনের পর আমাদের মুক্তিযোদ্ধা-জনতা উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন দৈনিক সেবক’র চিফ রিপোর্টার ও বার্তা সম্পাদক এবং বিচিত্রা’র ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ১৯৮৬ সালে দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশের সময় যোগ দেন যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হিসেবে, ১৯৮৭ সালে নেন পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব। ২০০৫ সালে পদত্যাগ করে যোগ দেন ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য পিপলস ভিউ’র ডেপুটি এডিটর হিসেবে। ৬ মাস পর যোগ দেন জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ’র সহকারী সম্পাদক পদে। এরপর পালন করেন দৈনিক ভোরের ডাক’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব। এরপর তিনি যোগ দেন ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন’র নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। মাস ছয়েক পর হৃদরোগ-অস্ত্রোপচারের কারণে চট্টগ্রামে চলে আসেন। সর্বশেষ দৈনিক পূর্বদেশ’র নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। এরপর ব্যস্ত হয়ে যান লেখালেখি ও গবেষণায়। বর্তমানে মুক্তি ৭১ডটকম এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯
এসি/টিসি