ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মাইলেজ রীতি, কেউ কথা রাখেনি

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২২
মাইলেজ রীতি, কেউ কথা রাখেনি ...

চট্টগ্রাম: রেলমন্ত্রী থেকে জিএম কেউ কথা রাখেনি। দেড়শ বছরের পুরোনো রেলওয়ে রানিং স্টাফদের মাইলেজ পদ্ধতি।

সম্প্রতি আইবাস প্লাস প্লাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে রানিং স্টাফদের বেতন-ভাতা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।  

তবে এ সংস্থাটির বিভিন্ন ভাতা ভিন্নতর হওয়ায় জটিলতার মুখে পড়েছে রেলওয়ে।

এক বছর ধরে তারা বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও কোন কুলকিনারা না পেয়ে অবশেষে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।  

প্রায় প্রতিনিতই আন্দোলন করছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এ নিয়ে তারা রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। তিনিও তাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। এছাড়া পূর্বাঞ্চলের জিএম জাহাঙ্গীর হোসেনও কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি।  

বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) রানিং স্টাফদের বেতনের সঙ্গে মাইলেজ দেওয়ার কথা থাকলেও তারা মাইলেজ রীতিতে বেতন-ভাতা না পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন।  

সর্বশেষ ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলন্ত ট্রেনে দৈনিক ১০০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করলেও ওই দিনের বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি মাইলেজ ভাতা পাবেন না সংশ্লিষ্ট রানিং স্টাফ। আর মাস শেষে এই মাইলেজ মূল বেতনের বেশি হবে না। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন রেলওয়ের রানিং স্টাফরা।  

জানা গেছে, রেলওয়ের সংস্থাপন কোডের বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক রানিং স্টাফ এবং লোকোমোটিভ রানিং স্টাফদের ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে মূল বেতনের ভিত্তিতে রানিং অ্যালাউন্স প্রদানের প্রস্তাব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানিং স্টাফদের বিশেষ এ ভাতা প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু সম্প্রতি ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে বিশেষ ভাতা সীমিত হয়ে যাওয়ার ঘোষণা মানছেন না রানিং স্টাফরা।  

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), গার্ড ও টিকিট টেকার (টিটি), গার্ড(ট্রেন পরিচালক), টিটিই(ট্রাভেলিং টিকেট এক্সামিনার)। যারা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ট্রেন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন ও স্বাভাবিক রাখতে এসব রানিং স্টাফের দৈনিক নির্ধারিত ১২ কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে।  

একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ডিউটি শেষে পরবর্তী ১৬ ঘন্টা বিশ্রামে যেতে পারেন বা ব্যক্তিগত কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু একজন লোকোমাস্টার ডিউটি শেষ করার পরেও সবসময় অতিরিক্ত ডিউটির জন্য তৈরি থাকতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ফোন পাওয়া মাত্রই সাড়া দিতে হয়।  

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঈদের ছুটি, পূজার ছুটি, রাষ্ট্রীয় অসহযোগের সময় রেলওয়ে লোকো মাস্টারকে ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। তাদের কোনও ছুটি নেই। সমস্ত মানবসৃষ্ট আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে তাদের ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। বছরে ৩৬৫ দিন তাদের ২৪ ঘন্টা ডিউটি করতে জয়। সেই বিবেচনায় বৃটিশ আমল থেকেই ট্রেনের লোকোমাস্টাররা ‘মাইলেজ’ পান। ট্রেন চালকদের ডিউটির সাথে অন্য কারও ডিউটির তুলনা চলে না।

মাইলেজ কি? 

সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রেলওয়ে ট্রেন চালকদের (রানিং স্টাফ) যে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় সেটি বৃটিশ আমল থেকে মাইলেজ নামে পরিচিত। এছাড়াও রেলওয়ে রানিং স্টাফরা প্রতি ৮ ঘন্টা কর্ম সম্পাদনের জন্য ১ দিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ যে অর্থ প্রদান করা হয়, তা-ই মাইলেজ।

রেলওয়ের ১৮৬২ সালের আইন অনুযায়ী ট্রেন চালক, সহচালক, পরিচালক ও টিকিট চেকারদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫-১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এজন্য তাদের দেওয়া হয় বিশেষ আর্থিক সুবিধা যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ, ওই পদে নিয়োগ বিধিমালাতে সেটাই বলা আছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী শত বছর ধরে তারা সেই হিসেবে বেতনও পেয়ে আসছেন। মাইলেজের হিসেব হলো, প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক বেসিকের সম পরিমাণ টাকা বেশি পাবেন। ৮ ঘণ্টায় একদিনের কর্মদিন ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা দুই তিন মাসের সম পরিমাণ। তাদের বেতনও সেইভাবেই দেওয়া হয়। এছাড়াও মূল বেতনের হিসেবে অবসরকালীন ভাতা যা হয় তার সাথে অতিরিক্ত আরও ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেওয়া হয়। রেলে প্রচলিত এই পদ্ধতিকে বলা হয় মাইলেজ।

কিন্তু সম্প্রতি রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মীদের মূল বেতনের অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার বিধান নেই মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে রেলের রানিং স্টাফদের মাইলেজ সুবিধা বাতিল করে দেয়। এতেই ক্ষিপ্ত হন ট্রেনের রানিং স্টাফরা। ফলে তাদের বেতন নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। এই বেতন জটিলতার নিরসন ও মাইলেজ পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে রেলের রানিং স্টাফরা।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান মজিব বাংলানিউজকে বলেন, রেলওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬২ সালে প্রায় দেড়শ বছরের বেশি সময় আগে। ওই সময় থেকে রেলওয়ে অ্যাক্ট অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছেন রানিং স্টাফরা। হঠাৎ করে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যেখানে আমাদের বেতন-ভাতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়মে নির্ধারিত সময়ের পর কর্মীরা কাজ বন্ধ করে দেবেন। এতে বিঘ্ন হতে পারে রেলের স্বাভাবিক চলাচল। এ ব্যাপারে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। রেলমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন।

বাংলাদেশ শ্রমিকলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রনালয়ের প্রজ্ঞাপন রেলওয়ে রানিং কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগে থেকে। আমরা চেয়েছি আমাদের কষ্টের ন্যায্যতা ফিরে পেতে। বাংলাদেশ রেলওয়েতে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় রয়েছে যা অর্থ মন্ত্রণালয় উপলব্ধি করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রনালয়ের প্রজ্ঞাপন দেয়ার আগে আরো দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রায় ১২ মাস আমরা রেলওয়ের বিভিন্ন দফতরে গিয়ে বৈঠক করেছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ রাখেনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক আব্দুল বারি বাংলানিউজকে বলেন, মাইলেজ হলো ‘পার্ট অব পে’। কাজ করলেই পাই। না করলে পাই না। এটি বৃটিশ আমল থেকে চালু। এ জটিলতা নিরসনের জন্য আমরা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি, যাতে দেশের সম্পদের কিঞ্চিৎ পরিমাণ ক্ষতি না হয়। কিন্তু আমাদের কথা কেউ রাখেনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০২১
বিই/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।