কলকাতা: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চক্রান্তে নবাবি হারিয়ে ওয়াজেদ আলি শাহ নদীপথ পেরিয়ে ১৮৫৬ সালের ১৩ মে কলকাতায় পৌঁছান। তার ম্যাকলয়েড জাহাজ সেদিন নোঙর করেছিল কলকাতার মেটিয়াবুরুজের বিচালি ঘাটে।
এই মেটিয়াবুরুজ এলাকা দীর্ঘদিন থেকেই বন্দর এলাকা হিসেবে পরিচিত। তবে সেদিন কি নবাব বুঝেছিলেন তার জীবনের বাকি দিনগুলো কাটবে কলকাতায়, আর তার হাত ধরে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে বৈচিত্র্য আসবে?
কলকাতায় যে আলু দেওয়া বিরিয়ানি পাওয়া যায় তা ওয়াজেদ আলির অবদান। এই ওয়াজেদ আলির জন্যই বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাংলা।
শুধু বিরিয়ানি কেন, তার রসনা তৃপ্তির জন্যই বাংলা পেয়েছিল ‘দমপোখত’ বা ‘ঢিমে আঁচে’ রান্না। অনেকের মতে, অর্থাভাবের কারণে মাংসের বদলে বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন করেছিলেন ওয়াজেদ আলি। তবে তথ্য বলছে, তার জামানাতে মাংস ও আলুর দাম প্রায় সমানই ছিল। পর্তুগিজদের ব্যবহৃত আলু আর মাংসের ফিউশনে তার আমলেই শুরু বিরিয়ানি। কারণ, তিনি নিজে যেমন খাদ্যরসিক ছিলেন তেমন খাওয়ানো খুব সৌখিন ছিলেন।
তার হাত ধরেই বাংলা পায় ঠুমরি ঘরানার সংগীত, কত্থক নৃত্য বা ঘুড়ি ওড়ানোর মতো বিষয়গুলো। শুধু কি তাই, নবাবি ফিরে পেতে নবাব যেদিন অওধ থেকে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি দিলেন লর্ড ক্যানিংয়ের দরবারে দাবি জানানোর লক্ষ্যে, সেই দিনই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বাবুর্চি, দরজি, ঘুড়ি তৈরির শিল্পী, লক্ষ্ণৌর কবি সাহিত্যিকদের। তার হাত ধরেই বাংলা পায় শেরওয়ানি, চুরিদার, ঘাগড়া, সালোয়ার কামিজ। তার সময়কাল থেকে বাংলায় ব্যাপক ব্যাপ্তি পায় কুর্তা-পাঞ্জাবির।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে আওয়াধের নবাবরা বেশ কিছুদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। যদিও ইতিহাস বলছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোঘলদের ঠেকাতেই নিজেদের স্বার্থে এসব নবাবদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। কারণ, অওধের নবাবরা ছিলেন তীব্র মুঘল বিরোধী। তখন ভারতের বড়লাট লর্ড ক্যানিং কলকাতা থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সেই সময় তারই এক কর্মচারী রিপোর্ট দিলেন যে, অওধের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। দেখা দিয়েছে আর্থিক সংকট। তবে ইতিহাস বলছে, ওই কর্মী নবাবি কেড়ে নেওয়ার সুপারিশ করেননি। তবুও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল অওধের নবাবি।
ফোর্ট উইলিয়ামের নজরবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে ওয়াজেদ আলি ঠিক করেছিলেন কলকাতাতেই কাটিয়ে দেবেন বাকি জীবন। তাই কলকাতার মেটিয়াবুরুজে গড়ে তোলেন লক্ষ্ণৌর আদলে। একে একে গড়ে তোলেন বহু বাড়ি, যদিও সেসব বাড়ির বেশিরভাগ পরে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। গড়ে তোলেন চিড়িয়াখানা, সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য শিস মহল, ধর্মপালনের জন্য ইমামবাড়া। তার শিস মহলে কাব্যচর্চা, সংগীত চর্চা, নৃত্যচর্চার জন্য লক্ষ্ণৌ, বারানসি ও এলাহাবাদ থেকে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের নিয়ে আসেন কলকাতায়।
তবে তা শুধু নিজেদের শোনা বা পরিবেশনের জন্য নয়। শুরু হলো স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ। ফলে কলকাতা পেলো রাজা সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যদু ভট্টের মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের। ওয়াজেদ আলি ছিলেন একাধারে শাসক, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার, নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার, পশুপ্রেমিক এবং সব ধরনের শিল্পকলায় একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। তাই নবাবের হাত ধরে বাংলা পায় বহু গণ্যমান্য শিল্পী। বাংলায় আমূল পরিবর্তন আসে খাদ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে।
তবে নবাবি চলে যাওয়ার পরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা ওয়াজেদ আলি শাহকে একবার ভীষণ ভয় পেয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধারণা করেছিল, বিদ্রোহী সিপাহীরা হয়তো ওয়াজেদ আলিকেই সমর্থন করে বসবে। তাই নবাবকে নজরবন্দি করে রাখা হলো কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে।
এক সময় লর্ড ক্যানিং এই ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ২১টি কামানের তোপ দেগে স্বাগত জানিয়েছিলেন ওয়াজেদ আলি শাহকে। সেই নবাবকে ভয় পেয়ে ১৮৫৭ সালের ১৬ জুন গ্রেপ্তার করে নজরবন্দি করে রাখা হয় প্রায় ২৬ মাস।
তার অবদান বাংলার সংস্কৃতিতে যেভাবে মিশে গেছে এবং যা পেয়েছে ভারত তথা বাংলা, সেই ইতিহাস মুছে দেবে- এমন শক্তি কোন শাসকের?
বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, ২৬ মে, ২০২৩
ভিএস/আরএইচ