কলকাতা: বাংলা বছর ১৪২১ সাল’কে বরণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে বাঙালিদের মধ্যে। যেখানেই বাঙালি আছেন সেখানেই তারা নিজেদের মত করে পরিকল্পনা করছেন নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে।
নববর্ষ বরণের প্রস্তুতির একটি বিশেষ অঙ্গ “চৈত্র সেল”। কলকাতার বাজারগুলোতে “চৈত্র সেল” এখন তুঙ্গে। উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার চৈত্র সেল জমজমাট। দোকানদাররা তাদের দোকানের বাইরে “চৈত্র সেল”র ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেন মাস খানেক আগেই। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে ইংরেজি মাসের প্রথম দিক থেকে। পয়লা বৈশাখের আগের রোববারটি নিয়ে খুবই আশাবাদী দোকানদাররা।
কলকাতার ‘চৈত্র সেলের’ সুলুক সন্ধান নিতে বাংলানিউজ হাজির কলকাতার বিভিন্ন বাজারে। উত্তরের হাতিবাগান থেকে দক্ষিণের গড়িয়াহাট আর মধ্য কলকাতার নিউ মার্কেট, শেষ চৈত্রের সেলের বাজারে ঠাসাঠাসি ভিড়। তবে শুধু হাতি বাগান, গড়িয়া হাট বা নিউ মার্কেট কেন গোটা কলকাতার প্রায় সমস্ত বাজারেই ভিড় উপচে পড়ছে।
একদিকে প্যাচপেচে গরম। তাপমাত্রা মাঝে মাঝেই ছুয়ে যাচ্ছে চল্লিশের দিকে। আর তার সঙ্গে লোকসভা নির্বাচন বাড়িয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ। বৃষ্টির দেখা নেই। কিন্তু তার পরেও মোটেও উৎসাহ কমেনি কলকাতার বাঙালিদের।
ভিড়ের মধ্যে গলদঘর্ম হয়ে দুই হাতে গোটা পাঁচেক প্লাস্টিকের পেট মোটা ব্যাগ কোন রকমে ঝুলিয়ে মাথার ঘাম আক্ষরিক অর্থে পায়ে ফেলে প্রায় যুদ্ধ জয়ের মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরছেন মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণীরা।
মনের আশা মিটিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিষ থেকে শুরু করে পোশাক–পরিচ্ছদ কিছুই বাদ যাচ্ছে না এই “চৈত্র সেল”-এর কেনাকাটায়। কেউ কেউ আবার গোপনে ঈদ আর পূজারবাজারও কিছুটা সেরে ফেলছেন এই সুযোগে।
গৃহকর্তাকে গিন্নিরা বিপুল উৎসাহের সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছেন কেনাকাটি করে তারা আদতে সংসারের কি বিপুল পরিমাণ অর্থ বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। কারণ এত সস্তায় সারা বছরের কোন সময়ে জিনিষ কেনা যায় না!
শুধুমাত্র মধ্যবিত্ত বাঙালি যে “চৈত্র সেল”-এর বাজারে ভিড় করছেন তা নয়- উচ্চবিত্ত ঢুঁ মারছেন গড়িয়া হাট, নিউ মার্কেটের দোকানে। আর শুধু পোশাক নয় গয়নার দোকানেও দারুণ ভিড়। কলকাতার একটি দোকান “চৈত্র সেল”–এ হিরের গয়নার উপর বিশেষ ছাড় দিয়ে শহর জুড়ে বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
নববর্ষের শুরুতে গয়না কেনার রেওয়াজ বাঙলার মানুষের মধ্যে দেখা যায়। আর সেই রেওয়াজটাকেই বিপণনের কাজে লাগাচ্ছেন গয়নার দোকানগুলি। তবে ইদানীং কালে অবাঙালি প্রথা ‘ধনতেরস’ কিছুটা প্রতিযোগিতায় ফেলে দিয়েছে পয়লা বৈশাখের গয়নার কেনাকাটা। আর সোনার দাম বেড়ে যাওয়াও এর একটা কারণ। তবে আজকাল হিরের গয়নার প্রতি বাঙালিরা বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
কলকাতার একটি শপিং মলে ঢোকার মুখেই দুই কিশোরী হাসি হাসি মুখে কতটা ‘বিশেষ ছাড়’ পেয়ে তারা কত সস্তায় পোশাক কিনেছে এই আলোচনা করতে করতে পাশ দিয়ে চলে গেল। শপিং মলগুলি অবশ্য “চৈত্র সেল”র জন্য অপেক্ষা করে না।
তারা বছরে অন্তত তিন বার বিশেষ ছাড়ে জিনিষপত্র বিক্রি করে। “ইয়ার অ্যান্ড সেল”, আবার কখনও “স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল” নানা নামে।
“চৈত্র সেল”র বিষয় নিয়ে বাঙালি তার ঐতিহ্যকে যে জোরদার ভাবে বজায় রেখেছে তার বড় প্রমাণ মেলে বাজার গুলিতে গেলে। অন্তত দোকানগুলোর ভিড় দেখে সেই বিশ্বাসটাই প্রবল হয়।
নববর্ষ প্রসঙ্গে কথা হয়েছিল একসময় বাংলাদেশে বসবাস ছিল আমার এক আত্মীয়ার সঙ্গে। তাঁর মুখে শোনা দেশ ভাগের আগের পয়লা বৈশাখের কথা। বাংলাদেশের রংপুরে তার জন্ম। মাত্র নয় বছর বয়েসে তিনি বিয়ের পর কলকাতায় আসলেও তার কথায় সামান্য হলেও রংপুরের টান ছিল।
রংপুরের জন্যই শ্বশুরকুলে তার নামছিল রাঙা বউ। রাঙা পিসি, রাঙা বৌদি আর আমাদের রাঙা দিদা। তাঁর মুখে শুনেছি সেই সময় প্রতিটি বাড়িতে নতুন বছরে নানা ধরনের পিঠা ও মিষ্টি তৈরি হত। বাড়ির মেয়েদের আলাতা পরাতে আসত নাপিত বউ। ঝামা পাথরে পা ঘসে তারপর আলতা পড়ান হত। বাড়িতে আসত ঘ্রাণতেল আর বাড়ির বউরা মেলায় গিয়ে কিনতেন রঙিন কাঁচের চুড়ি।
তাঁর কাছে আরও শুনেছিলাম বাড়িতে রান্না হত সরষে ইলিশ, কই মাছের দো পেঁয়াজো আর কাঁচা আমের টক বা চাটনি। দোকানে গেলে মিষ্টির সঙ্গে দেওয়া হত আম পোড়ার শরবৎ ।
পাড়ার কোন দালানবাড়ির সামনে মঞ্চ বেঁধে পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় নাটক করত পাড়ার যুবকরা। কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাদলের প্রথম শো হতো এই পয়লা বৈশাখের দিনেই, সঙ্গে ছিল কলকাতার সঙ। আর ছিল হাল খাতার নিমন্ত্রণ। সেই নিমন্ত্রণ আজও আছে।
“চৈত্র সেল” থেকে জিনিষ কিনলে মনটা খুশি হয় অনেকেরই। কেননা “চৈত্র সেল”র সময় দাম নেমে আসে মনের দামের কিছুটা কাছাকাছি। আর সেখানেই কেনাকাটার পরম তৃপ্তি। আর সেটাই টিকিয়ে রেখেছে “চৈত্র সেল” বাজারকে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৪