‘দিন যে গেল, সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে’ গানটা কাঙাল হরিনাথের লেখা। তাঁর পুরো নাম হরিনাথ মজুমদার।
স্বপ্নের থেকে বাস্তবের দূরত্ব বাড়লে, শঙ্কা শাসন করে কম। ব্যর্থতার ছবিটা বার বার ভেসে ওঠে। তাড়াতে চাইলেও যায় না। মৌরসীপাট্টা করে বসে থাকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম থেকে যে খবর আসছে তাতে তিনি বিচলিত। ভরসা দিচ্ছে না কেউই। সব ছেড়ে মোদী আঁকড়ে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গকে। একটা নয়— তিন তিনটে জনসভা করেছেন বঙ্গের মাটিতে। চিৎকার করে জানিয়েছেন, বাংলা তাঁর কাছে তীর্থস্থান। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরক্ত। নেতাজী বলেছিলেন, আমায় রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। আমি বলছি, আপনারা আমায় সমর্থন করুন, আমি আপনাদের সামর্থ্য যোগাব।
নেতাজীর সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে তিনি ঠিক করেননি। বাঙালি এটা মানবে না। মোদী কিন্তু জেনেবুঝেই এটা করেছেন। লাইফ ইমেজ তৈরি করতে এছাড়া কোনও উপায় ছিল না। মোদী এখন বেপরোয়া। ভোটের গন্ধ পেলেই ঝাঁপাচ্ছেন। একটা ভোটও তাঁর কাছে অনেকটা।
পশ্চিমবঙ্গে যে এবার বিজেপির ভোট বাড়ছে তা নিয়ে সংশয় নেই। নব্য মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের পছন্দ করছে। তাদের আকাশচুম্বী আকাঙ্ক্ষা অন্যসব রাজনৈতিক দলকে ঠেকে সরাতে চাইছে। রাজনৈতিক কচকচি তাদের ভাল লাগে না। শ্রমিক-কৃষকের করুণ কাহিনী শোনালে তারা কানে তুলো দেয়। তারা বলে, আমরা শুধু আমদেরটা ভাবব। অন্যের কথা ভাবতে আমাদের বয়েই গেছে। একটার পর একটা সাফল্যের দরজা খুলে তারা এগোচ্ছে। পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে মুখের মণিমুক্তো কুড়োচ্ছে। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, ভোগের সিংহদুয়ার মোদী খুলে দিতে পারবেন। তৃণমূল পারত। কিন্তু তিন বছরে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে দৈন্য দশা। তাছাড়া, তাদের তো কেন্দ্রে সরকার গড়ার মুরোদ নেই। কাজকর্ম সবই আঞ্চলিক। সিপিএমের সঙ্গে ঝগড়া বন্ধ করলে রাজনীতি শেষ। আর সিপিএমের সমাজতন্ত্রের মন্ত্রটা বড় যন্ত্রণার। তারা জানে না, বীরভোগ্য বসুন্ধরা। যারা বীর তারাই পৃথিবী ভোগ করতে পারে। সবাই নয়। এদের সঙ্গে অন্যের তফাৎটাই ব্যক্তিত্ব। আমার আছে ওর নেই, সেটা বিষয়। গরীব না থাকলে ধনীর সমাদর কীসের।
মোদী এই নব্য মধ্যবিত্তদের ঘাড়ে জাল ফেলেছেন। তাদের সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ রাজ্যে নতুন ভোটারদের একটা বড় অংশ তারাই। এর পুরোটা না হলেও কিছুটা বিজেপির ঝুলিতে গেলে, কম লাভের নয়। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত। এই ভোটটা যাবে তৃণমূলের থেকেই। কংগ্রেস এখনও যথেষ্ট দুর্বল। গতবার তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে পেয়েছিল মাত্র ৬টি আসন। এবার সেটা ধরে রাখা খুবই কষ্টকর। কারণ, লড়াইয়ে তারা একা। তৃণমূলের ভোটের যে সাপোর্ট ছিল, সেটা নেই। নিস্তেজ দলে ঝাঁঝ আনতে রাজ্য সভাপতির পদে বদল ঘটিয়েছেন রাহুল গান্ধী। এনেছেন লড়াকু নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীকে। যাঁর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক সাপে-নেউলে।
অধীরের অসুবিধে হচ্ছে, তাঁর নিজের এলাকা বহরমপুরের বাইরে খুব একটা প্রভাব খাটাতে পারছেন না। তবু প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন রাজ্য চষে কংগ্রেস কর্মী-নেতাদের মনোবল বাড়াতে। বিজেপি তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসও ভোটে ভাগ বসাতে আশাবাদী। সুবিধেটা বামফ্রন্টের। ২০০৯ এর লোকসভায় ভোট থেকে পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা ভোটে হারতে হারতে তারা ক্লান্ত। কর্মীদের একটা বড় অংশ প্রাপ্তির আশায় তৃণমূলে। এ অবস্থায় বিজেপি তাদের কাছে শাপে বর হয়ে এসেছে। তৃণমূল বা কংগ্রেসের ভোট যদি তারা কাটতে পারে লাভ বামেদের আসন কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারবে। সেইসঙ্গে বিজেপিও প্রকাশ করতে পারবে তারা পশ্চিমবঙ্গে অচ্ছুৎ নয়। লোকের মনে তারাও জায়গা পেয়েছে। সেটা কম হোক আর বেশি।
বিজেপির টার্গেট, যেভাবেই হোক পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্তত গোটা পাঁচেক আসন তুলে নেওয়া। দার্জিলিং আর কৃষ্ণনগর আসন দুটিতে তাদের জোর বেশি। বিজেপি কোনও আসন পাক বা না পাক বাংলায় তারা নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করেই ছাড়বে। বুঝিয়ে দেবে পায়ের তলায় মাটি তাদেরও আছে।