কলকাতা: ১৯৫০ সালের ২০ মার্চ, রাতে কলকাতার নেতাজী ভবনে বসে শরৎ চন্দ্র বোস তার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দ্য নেশন’ পত্রিকার ২১ তারিখের সম্পাদকীয়র জন্য লিখলেন, ‘যখন বাংলাকে ভাগ করে দেওয়াই হয়েছে তখন আর কিছু করার নেই। কিন্তু তাকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হোক’।
সম্পাদকীয় শেষ করে তাতে স্বাক্ষর করলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের দাদা স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্যারিস্টার শরৎ চন্দ্র বোস।
সেটিই তার জীবনের শেষ স্বাক্ষর। এর পরে একটু কাশির শব্দ। খানিক পরে স্নান ঘরে আবিষ্কৃত হল তার মৃতদেহ। সম্ভবত ভবিষ্যতের অমোঘ রাজনৈতিক সত্যের কথাই সম্পাদকীয়র মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন ভারতের এই বিপ্লবী মানুষটি।
সময়টা ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। বর্তমানে কলকাতায় যেখানে বাংলাদেশ উপ হাই কমিশন সেটি সেই সময় ছিল পাকিস্তান উপ হাই কমিশন। এই বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তি যুদ্ধের নানা ইতিহাস। সেই সময় পাকিস্তানের উপ হাই কমিশনার ছিলেন হোসেন আলী। ২৫ তারিখ রাতে তৎকালীন পাকিস্তান উপ হাই কমিশনের অন্যতম সচিব আনোয়ারুল করিম এর বাড়িতে এক নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল।
একদিকে উত্তাল পূর্ববাংলা। মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে নেমেছে পাক সেনা বাহিনী। পশ্চিমবাংলার সাত কোটি বাঙালির মনে তখন একটাই প্রশ্ন পাক বাহিনীর সঙ্গে কি লড়াইয়ে পারবে মুক্তি যোদ্ধারা। । সেই দিনের নৈশভোজে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার তৎকালীন পুলিস প্রধান রণজিৎ গুপ্ত, ড. শিশির বসু এবং তাঁর স্ত্রী তথা ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য কৃষ্ণা বসু সহ আরও অল্প কয়েক জন।
ঐদিন সকাল থেকেই কলকাতার বেতারে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর আসছিল। বলা হচ্ছিলো বাংলাদেশে স্বাধীন পতাকা তোলা হবে। সন্ধ্যের নৈশভোজের টেবিলে তৎকালীন পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনার এম হোসেন আলী জানান, ঢাকার সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। হোসেন আলীর স্ত্রী বেগম হোসেন আলীর পৈত্রিক বাড়ি ছিল মাগুরায়। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা।
নৈশ ভোজের টেবিলে সমস্ত কূটনৈতিক বাঁধা ভেঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়েন হোসেন আলী। তিনি বাঙলা ভাষা এবং বাঙালিদের পক্ষে স্বাধীনতার জোরালো সয়াল করেন।
২৫ মার্চ রাতে একটা তীব্র উৎকণ্ঠা কাজ করছিলো সকলের মধ্যে। কলকাতার পুলিস প্রধান রণজিৎ গুপ্ত আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন তার কাছে খবর আছে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত। এ নৈশ ভোজের টেবিলে হোসেন আলী মহাশয় গেয়ে ওঠেন “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা...”। উপস্থিত সকলে তাতে গলা মেলান।
কলকাতার ছাত্র সমাজ এই লড়াইয়ের সমর্থনে পথে নামে। ২৭ মার্চ বাম ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশন(ডান), পি এস ইউ-ডি এস ও, এফ আর এস প্রমুখ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন হরতালের ডাক দেয়। এই হরতাল ছিল সর্বাত্মক। ২৮ জানুয়ারি কলকাতায় যুব কংগ্রেসের ডাকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে অনশনে সামিল হন যুবকরা।
২৯মার্চ দিনটি এই প্রসঙ্গে খুবই উল্লেখযোগ্য। ঐ দিন ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই একটি খবর প্রকাশ করে জানায়, কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিফৌজের কমান্ডার টেলিফোনে জানিয়েছেন ভারত যেন চুপ করে বসে না থাকে। এই খবরে আরও বলা হয় মুক্তি ফৌজের ঐ কমান্ডার বলেছেন, ‘আমারা শত্রুপক্ষীয় দেশের অধিবাসী হতে পারি কিন্তু শত্রু নই।
ঐ দিনই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন কংগ্রেস সভাপতি। এর পরের দিন ৩০ তারিখে কলকাতার সাংবাদিকরা বাংলাদেশ থেকে সমস্ত বিদেশি সাংবাদিকদের বিতাড়িত করবার বিরুদ্ধে পাক হাই কমিশন পর্যন্ত মিছিল সংগঠিত করেন।
২৯ তারিখেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ২ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ওয়ার্কিং কমিটির তরফ থেকে জানা হয় তারা বাংলাদেশের মানুষের পাশে থাকবে। এবং গোটা বিশ্বকে জাতীয় কংগ্রেসের তরফে পাক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার আবেদন জানান হয়।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া সীমান্তে নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমেদ –এর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাঙলা সরকার’ গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এটি ছিল ভারতের বুকে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন।
এই উপলক্ষে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আনন্দবাজারে সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, হিন্দুস্তান টাইমসের তুষার পণ্ডিত, যুগান্তরের জিয়াদ আলী সহ আরও অনেক সাংবাদিক। এই সাংবাদিক সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমেদকে ‘স্বাধীন বাঙলা সরকার’-এর প্রধান ঘোষণা করা হয়।
ঠিক সেই সময় কলকাতার তৎকালীন পত্রিকায় খবর প্রকাশ পায়, পাক ফৌজের পশ্চিমবঙ্গ (মুর্শিদাবাদ) সীমান্তে ঢুকে শরণার্থী বাঙালি নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং লাঞ্ছনার খবর। তাদের এই ঔদ্ধত্বে দুই পারের বাঙালিরা কোন মতেই মেনে নিতে পারেনি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথম কলকাতার উপ হাইকমিশনার হোসেন আলী পাকিস্তান উপ হাই কমিশন পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখনও দিল্লীর হাই কমিশনার পদত্যাগ করেননি। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বেলা ১২টার পর বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। হোসেন আলী পাকিস্তান হাই কমিশন নেমপ্লেট সরিয়ে বাংলাদেশ হাই কমিশনের নতুন নেমপ্লেট লাগান হাই কমিশন ভবনে। মহম্মদ আলী জিন্না ও স্যার ইকবালের ছবি নামিয়ে তখনি নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি টানিয়ে দেওয়া হয়। তৎকালীন কলকাতার খবরের কাগজগুলিতে গুরুত্বের সহকারে প্রথম পাতায় প্রকাশ হয় এ খবর। এই দূতাবাসই তৎকালীন সময় ভারতে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ হাইকমিশন।
উল্লেখ্য এম হোসেন আলীর এই সিদ্ধান্তে বেগম হোসেন আলীল যথেষ্ট প্রভাব ছিল বলে জানা যায়। চার সন্তানের জননী বেগম হোসেন আলী, ১৮ এপ্রিল যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিককে জানান , ‘আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরে রক্ত স্রোত বইছে। তারপরেও কি করে তাঁকে (হোসেন আলী) বলব টাকার জন্য ঐ নরখাদকদের অধীনে চাকরি করতে। তাই আমি বোঝাচ্ছি হয় স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের ছাড়ো নয় ইসলামাবাদের পশুদের ছাড়ো’।
এই ঘোষণার পরেই কলকাতার ৯ নম্বর সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে শতশত কলকাতাবাসী হোসেন আলী ,বেগম হোসেন আলী এবং কমিশনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানান।
কলকাতায় পাকিস্তান হাই কমিশনের দপ্তরের প্রধান এবং কর্মচারীদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের বিষয়টি জানিয়ে পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে একটি নোট ভারত সরকারকে পাঠানো হয়। সেই নোটের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার কৌশলী উত্তরে জানায়, ‘এটা পাকিস্তানের নিজস্ব ব্যাপার। এখানে ভারতের কোন বক্তব্য নেই। ভারত কাউকে জোর করে উচ্ছেদ করতে পারে না’।
এর পরেই মেহেদী মাসুদ মহাশয়কে পাকিস্তানের উপ হাই কমিশনার করে কলকাতায় পাঠান হয়। তিনি ২১ এপ্রিল কলকাতায় হাজির হন। ঐ দিন কলকাতায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। মেহেদী মাসুদ কলকাতার তিনটি হোটেলে চিঠি লিখে থাকার বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু কেউ তার চিঠির উত্তর দেয়নি। বেশি রাত পর্যন্ত তিনি বিমানবন্দরেই কাটান বলে পত্রিকা গুলোর খবরে জানা যায়।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে ওপারের ৭ কোটি বাঙালির পাশে কি ভাবে পশ্চিমবাঙলার ৫ কোটি বাঙালি সমর্থন করে যাচ্ছিল। শুধু সমর্থনই নয় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় সামগ্রী ইত্যাদি দিয়েও তাদের সাহায্য কারুর অজানা নয়। আর এই ঘটনা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল কলকাতার ৯ নম্বর পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউ-এর উপ হাই কমিশন ভবন থেকে। এই ভবনের বর্তমান ঠিকানা ৯ নম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সরণি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, মার্চ ২৫ , ২০১৫