কলকাতা: ৮ জানুয়ারি মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিক তার ৯ দিন বাদে ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ কলকাতা থেকে এক দল চিকিৎসক মোটরগাড়ি চালিয়ে খুলনা হয়ে ঢাকায় হাজির হন।
ডঃ শিশির কুমার বোস একদিকে যেমন ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক অন্যদিক তিনি ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি ঢাকায় গিয়ে ১৭ জানুয়ারি সরাসরি বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন।
শিশির কুমার বোসকে দেখে জড়িয়ে ধরেন বঙ্গবন্ধু। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন 'আমার সব শেষ হইয়্যা গেছে'। শিশির কুমার বোস বঙ্গবন্ধুকে বলেন, যারা দেশের জন্য রক্ত দেয় তাদের কোন কিছুই হারিয়ে যায় না। বাংলানিউজকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের যোগাযোগের কথা বলতে গিয়ে এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন প্রয়াত শিশির কুমার বোসের স্ত্রী ভারতের সাবেক সংসদ সদস্য কৃষ্ণা বোস।
তবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বোস পরিবারের যোগাযোগ এতটুকুই নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল নেতাজী ভবনকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পরিকল্পনার সাক্ষী ছিল কলকাতার নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বাড়িটি।
তবে যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, নেতাজী সুভাষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ হয়েছিল তার অন্তত ৩১- ৩২ বছর আগে। সেটা ১৯৪০ সাল।
কলকাতার পুরানো ফোর্ট উইলিয়ামে যেটি বর্তমানে বিনয়-বাদল-দিনেশ বাগ বা বিবাদী বাগ নামে পরিচিত, সেখানে একটি মিনার ছিল যাকে বলা হোতো ‘ব্ল্যাক হোল’। ব্রিটিশরা দাবি করতেন সিরাজ-উদ-দোল্লাহ এই মিনারের অপরিসর জায়গায় কয়েকজন ব্রিটিশ সেনাকে ঢুকিয়ে হত্যা করেন। যেটা আদপে সত্য নয়।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এই ব্ল্যাক হল মিনারটিকে সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪০ সালে ব্রিটিশরা আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয় এই মিনারকে সরিয়ে ফেলতে। এই সময় শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজ বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজের ছাত্র হিসেবে কলকাতায় অবস্থান করছেন। নেতাজীর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনিও এই আন্দোলনে সামিল হন। এখানেই তার নেতাজীর সঙ্গে পরিচয় হয়। এই কথা নিজে শিশির কুমার বোসকে জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়াও নেতাজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হবার কথা বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
তবে পরিচয়ের শুরু এখানে হলেও দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছর পর সেই নেতাজীর বাড়িকে কেন্দ্র করেই চলেছিল মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড।
নেতাজীর বাড়িতে বসেই পরিকল্পনা করা হয়েছে ‘জয়বাংলা’ নামে একটি পত্রিকার। তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি ছিল ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’।
যশোর সীমান্তে একটি দোতলা বাড়িতে এই হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। ড. শিশির কুমার বোস, বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ড. সত্যেন বসু রায় সহ কলকাতার একদল চিকিৎসক নিয়মিত এই অস্থায়ী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন।
গুলিতে আহত বহু মুক্তিযোদ্ধাকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা করা হত। শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয় প্রচুর সংখ্যক শরণার্থীদের চিকিৎসাও করতেন এই চিকিৎসকরা। কলকাতায় মহিলাদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি দেখতেন বিপ্লবী বীণা ভৌমিক।
বীণা ভৌমিকের নেতৃত্বে কৃষ্ণা বসু সমেত মহিলারা কলকাতা থেকে ঔষধ বড় বড় বাক্সে ভরে ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এ নিয়ে আসতেন। তারা আহতদের সেবা শুশ্রুষা করতেন।
সেই সময় পাকবাহিনীর বন্দুক থেকে নির্গত বুলেটে আহত এমন রোগীর সংখ্যাই বেশি ছিল। ড. সত্যেন বসু রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই বুলেট দ্বারা আহত রোগীদের অপারেশন করতেন বলে জানা যায়। তারা সুস্থ হয়ে অাবার দেশের সংগ্রামে ফিরে যেত।
মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য কলকাতা থেকেও ঔষধ সংগ্রহ করা হত। প্রায় প্রতি দিনই কলকাতা থেকে চিকিৎসকরা গাড়ি চালিয়ে ‘নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল’-এ যেতেন।
তবে শুধু হাসপাতাল নয় নিয়মিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নেতাজী ভবনে আসতেন এবং বৈঠকে মিলিত হতেন। এই ভাবেই নেতাজীর অনুপস্থিততে নেতাজী ভবন অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫ , ২০১৫