ঢাকা: মধ্য-রমজানে এসে রাজধানীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম আরও কিছুটা কমেছে। চাল আর সয়াবিন ছাড়া আর সব পণ্যের দাম হয় কমেছে, না হয় রমজান মাসের শুরুর দিনের দামেই বিক্রি হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর মিরপুর ১০, মিরপুর ১৩, মিরপুর ২, মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেটের কলমিলতা বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর বাজারে মেশিনে ভাজা প্রতি কেজি মুড়ির দাম ৯০ টাকা। রোজার প্রথম দিন বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি দরে। রোজার শুরুর দিনের মতোই হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি দরে। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত মুড়ি।
দুই ধরনের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা থেকে ১২৫ টাকা কেজি দরে। কোনো কোনো বাজারে পাঁচ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। রোজার শুরুতে এসব ছোলা যথাক্রমে ১১০ টাকা ও ১২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সুপারশপে প্যাকেটজাত ছোলা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। কোনো কোনো বাজারে বেসন ৫ থেকে ১০ টাকা কম দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। অ্যাংকর ডালের বেসন প্রতি কেজি ৯০ টাকা কেজি।
রাজধানীর বাজারে চিকন মসুরের ডাল ১৪০ টাকা, বড় মসুরের ডাল ১১০ টাকা, ছোলা ১১০ টাকা, ছোলার ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, মুগডাল ১৮০ টাকা। রোজার শুরুর দামেই বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। তবে এর মধ্যে বড় মসুরের ডালের দাম কিছুটা কমেছে।
খোলা বিক্রি হওয়া ছোট বরই খেজুর ৪৫০ টাকা থেকে ধরন ভেদে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, খোলা নরম খেজুর ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, মরিয়ম খেজুর ৮০০ থেকে বাজার ভেদে ১০০০ টাকা। তিন ধরনের খেজুরের দামই কমেছে। রোজার শুরুতে এসব খেজুর মধ্য রমজানের চেয়ে যথাক্রমে ৫০ টাকা, ৫০ থেকে ৭৫ টাকা এবং ২০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল। এ ছাড়া প্যাকেটজাত খেজুর কোম্পানি ও দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
এবার লেবুর দামে বেশ ভুগিয়েছে ক্রেতাদের। ভালো মানের লেবু এখনো ৮০ টাকা হালি, তুলনামূলক ছোট্ট লেবু হালি প্রতি ৫০ থেকে ৬০ দরে বিক্রি হচ্ছে। রোজার শুরুতেও এমন দরে বিক্রি হয়েছে।
মিরপুর ১৩ নম্বরের স্টাফ কলোনি বাজারের দোকানদার সেকেন্দার আলী জানান, এখন রোজার সব ধরনের পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে। রোজার আগে মানুষ বেশি কিনেছিল, এখন চাহিদা কমেছে। কিন্তু সরবরাহ একই রয়ে যাওয়ার কারণে দাম কিছুটা কমে গেছে। এখন বেশি দাম বলে তো বসে থাকা যাবে না, কিছুটা কম দামে হলেও পণ্য বিক্রি করছি। আবার আড়তেও দাম কিছুটা কমেছে।
ভোজ্যতেল গত কয়েক মাস ধরেই চাহিদামতো পাওয়া যাচ্ছে না। গত কয়েকদিন ধরে সরবরাহ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, তবে আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ বিক্রেতাদের। বিশেষ করে আধা লিটার থেকে এক লিটার ওজনের বোতলজাত তেলের সংকট রয়েছে বাজারে। এসব তেল কম আয়ের মানুষ ব্যবহার করে থাকে। বাড়তি দাম দিলে তেল কোম্পানির লোকজন তেল সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ করেন অনেক দোকানদার। এজন্য আধা লিটারের বোতলে খুচরা মূল্য ৭৫ টাকা লেখা থাকলেও ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে তেল কিছুটা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। স্বপ্ন, প্রিন্স বাজার, মীনা বাজারের মতো সুপারশপে চাহিদামতো ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে। বোতলের গায়ে নির্ধারিত ১৭৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে।
মিরপুর ১৪ নম্বরের দোকানদার আসগর আলী জানান, চাহিদামতো তেল দিচ্ছে না কোম্পানির লোকজন। আবার বাড়তি দাম দিলে অন্য লোকের মাধ্যমে তেল পৌঁছে দেয় বা নির্দিষ্ট জায়গায় গেলে দেয়।
রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকাতে ক্রেতাদের মাঝেও স্বস্তি দেখা গেছে। ফার্মগেট কলমিলতা বাজারে আসা আশিকুল ইসলাম জানান, এবার রোজাতে অস্বস্তি তৈরি হয়নি। রোজার আগে ভয় ছিল, পণ্যের দাম বাড়তে পারে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়া মানে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। সেটা এবার হয়নি। রোজার বাকি দিনগুলোতেও আশা করি দাম বাড়বে না।
রমজানের শুরুতে শীত চলে যাওয়ায় বেড়েছে শাকের দাম। সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের শাক। বর্তমানে লালশাক ও পালংশাকের আঁটি ১৫ থেকে বাজার ভেদে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পুঁইশাক ও লাউশাক আগের মতোই ৩০ থেকে বাজার ভেদে ৪০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য শাকও আগের দামে বিক্রি হচ্ছে।
ইফতারিতে যথারীতি বেগুনির চাহিদা বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে লম্বা বেগুনে, দামও বাড়ে। এবারও লম্বা বেগুনের কদর বেড়েছে। বাজারে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে লম্বা বেগুন। রোজার শুরুর দিকের দামের তুলনায় কোনো কোনো বাজারে বেগুন ৫ থেকে ১০ টাকা কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
রমজান শুরুর দামেই বিক্রি হচ্ছে ফল। মালটা ধরন ভেদে ৩২০ টাকা থেকে ৩৪০ টাকা, আপেল ৩৩০ থেকে ধরন ভেদে ৩৬০ টাকা, কমলালেবু ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকা, আঙুর ৩২০ থেকে ধরন ভেদে ৩৫০ টাকা, নাশপাতি ৩৫০ টাকা, বেদানা ৪৬০ টাকা ও তরমুজ ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়িয়ে এবারও বেশি দামে তরমুজ বিক্রি করার ঝোঁক ছিল ক্রেতাদের। তবে অতিরিক্ত দামে না কিনে বিক্রেতাদের এবারও কম দামে বিক্রি করাতে বাধ্য করেছেন রাজধানীর ক্রেতারা। রমজানের শুরুতে প্রতি কেজি তরমুজের দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা হাঁকালেও এখন ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
এ ছাড়া কাঁচাবাজারে বেশিরভাগ পণ্য আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। পটল প্রতি কেজি ৮০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, করলা ১২০ টাকা, উস্তা ১০০ টাকা, ঢেঁড়শ ১০০ টাকা, মিস্টি কুমড়া ৪০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা, সিম ৬০ টাকা, মুলা ৬০ টাকা, কচুর লতি ১০০ টাকা, চিচিঙ্গা ও ধুন্দুল ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
৪০ থেকে ৫০ টাকায় মাঝারি সাইজের লাউ, বড় লাউ ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধরন ভেদে ২০, ৩০ ও ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে টমেটো। বাজার ভেদে হাইব্রিড শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, দেশি শসা ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভালো মানের পেঁয়াজের দাম ৫ টাকা কমেছে। পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। দেশি রসুন ১৩০ টাকা, আমদানির বড় রসুন ২৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
রোজা শুরুর তুলনায় কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম। প্রতি হালির ডিমের দাম ৪০ টাকা, প্রতি ডজন ১২০ টাকা। রোজার শুরুতে ডিমের হালি ছিল ৪০ টাকা। এখন বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা, সোনালি ৩০০ টাকা, কক ২৮০ টাকা এবং লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। রমজানের শুরুতে ব্রয়লার ২২০ টাকা, সোনালি ৩২০ টাকা, কক ৩০০ টাকা এবং লেয়ার ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
রোজা শুরুর দামেই বিক্রি হচ্ছে গরু ও ছাগলের মাংস। গরুর মাংস ৭৫০ টাকা, ছাগলের মাংস ১১৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
৪০০ গ্রামের ইলিশ ১,২০০ টাকা, ৫০০ গ্রামের থেকে বেশি ওজনের ইলিশ ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত এবং এক কেজি বা বেশি ওজনের ইলিশ ২,২০০ টাকা থেকে শুরু করে ২,৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রায় সব ধরনের মাছ আগের দামে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচকি ও মলা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের রুই ও কাতলা ৩০০ থেকে বাজার ভেদে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ছোট রুই-কাতলা ২৫০ টাকা, টাকি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা, বড় শোল ৮০০ টাকা। চাষের ট্যাংরা ৬০০ টাকা, নদী-বিলের ট্যাংরা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, বেলে মাছ ৬০০ থেকে ধরন ভেদে ৭০০ টাকা এবং মাঝারি বাইম ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রূপচাঁদা ১২০০ থেকে ধরন ভেদে ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া ২২০ টাকা, বড় সিলভার কাপ ও পাঙ্গাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকা এবং আকারে ছোট্ট মাছ ১৪০ থেকে ধরন ভেদে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বড় আইড় ও বোয়াল ৬০০ টাকা, বড় রুই ৪৫০ টাকা, কাতল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে।
বাজারে চালের দামে কিছুটা ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা গেছে। রমজানের শুরুতে যে চিকন চাল ৮৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, সেই চাল কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। বিআর-২৮ দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা কেজি দর। মোটা চালের দামও কিছুটা বাড়তি।
রোজায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনী পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক ও কর হ্রাস করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। পবিত্র রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেল, চিনি, আলু, ডিম, পেঁয়াজ, চাল, খেজুর ও তাজা ফলের ওপর আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট, অগ্রিম কর এবং আগাম করের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে ছাড় দিয়েছে। যে কারণে এবার রমজানের বাজারে পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়নি বলে মনে করেন রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।
রমজান মাসে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকার পেছনে ভূমিকা রেখেছে যথেষ্ট সরবরাহ। রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার মিরপুর-১১ ও কচুক্ষেতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব পণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ আছে। দামও বাড়েনি। বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম কমেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২৫
জেডএ/এমজেএফ