ঢাকা: বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের দ্বিতীয় প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক পোশাক খাতের জন্য ভয়াবহ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, উদ্যোক্তারা হয়েছিলেন শঙ্কিত।
মার্কিন প্রশাসন সেই ৩৭ শতাংশ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে। তবে এখনো আশঙ্কা রয়ে গেছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শুল্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম।
বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চলমান ১৬ শতাংশের অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার কারণে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো। এ শুল্ক দিয়ে কোনোভাবেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যেমন দ্রুত চিঠি দেওয়া হয়েছে, শুল্ক নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার পণ্যে আমাদের চেয়ে বেশি, ভারতের পণ্যে আমাদের চেয়ে কম এবং চীনের পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের ওপরে শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে বাংলাদেশের মার্কেট আরও ভালো হবে—এমন কথা কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন। এটা সঠিক নয় বলে মনে করেন শোভন ইসলাম। তিনি বলেন, একশ টাকার একটি পণ্যে ৩৭ শতাংশ বাড়তি ট্যাক্স দিয়ে বিক্রি করা কোনোভাবেই সম্ভব না। এটা কার্যকর হলে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হবে।
এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ১৫ দেশকে ‘ডার্টি ফিফটি’ অভিহিত করে বাড়তি ট্যাক্স আরোপের পরিকল্পনা করছিল। বাংলাদেশ ওই ১৫ দেশের মধ্যে থাকবে না, এমন আভাস দিয়েছিল। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশ যখন এই অত্যাধিক শুল্ক তালিকায় যুক্ত হয়ে গেল, সেটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা তৈরি করেছিল। যেভাবেই দেখি ৩৭ শতাংশ শুল্কে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব হতো না, শিল্পে ধস নেমে যেত।
বিশ্বজুড়ে বাড়তি শুল্ক বসানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জীবনযাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যেত। এতে সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যেত। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে দেশটির রিটেইলাররা ও জনগণ এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। তারা সর্বকালের বড় প্রতিবাদটি করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটে ধস নেমে আসে। তাদের নাইন ট্রিলিয়ন ডলারের পেনশন ফান্ডসহ বেশ কিছু তহবিল যা ওয়াল স্ট্রিটে ছিল, তা ধসে গিয়েছিল, বলেন পোশাক খাতের এই উদ্যোক্তা নেতা।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে শোভন ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট যে ট্যাক্স বসিয়েছে, এটা বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ট্যাক্স বসানো হয়নি, বসানো হয়েছে আমেরিকার কর্পোরেশনের ওপরে। কার্যত দেশটির জনগণকে এটা পরিশোধ করতে হবে। এসব বিষয় যখন উপদেষ্টাদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গেল, আমরা আশা করেছিলাম সোমবারের মধ্যেই একটি নতুন সিদ্ধান্ত আসবে। ওই দিন তারা চীনের পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক ঘোষণা করে পরিস্থিতি থামাতে চেয়েছিল। পরের দিনও যখন ধস চললো, তখন ট্রাম্প বাধ্য হয়ে এটা স্থগিত করেছেন।
শোভন ইসলাম বলেন, এটা ভুলভাবে আর্বিটারি হুট করে বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরো বিষয়টি যখন ট্রাম্পের পরিষদ বিবেচনা করল তখন অ্যাডিশনাল ট্যাক্স থেকে পিছিয়ে গেল। কিন্তু ১০ শতাংশ যে ভিত্তি শুল্ক বসিয়েছিল, সেটা বহাল রয়েছে। সেই সঙ্গে বর্তমান ১৬ শতাংশ শুল্ক বহাল রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছিল, সেটা থেকে পিছু হটেনি। বাড়তি শুল্ক আপাতত স্থগিত হলেও আমাদের এখন ২৬ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। স্থগিতের এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে আমরা বাঁচার মতো সময় পেলাম। ৩৭ শতাংশ শুল্কে আমরা ডুবে যাচ্ছিলাম।
‘যুক্তরাষ্ট্র সেই সব দেশের পণ্যের ওপর বেশি করে শুল্ক বসিয়েছে, যেসব দেশ বন্ধু নয় বা ডার্টি ফিফটি, বেশি পণ্য রপ্তানি করে কিন্তু তুলনমূলক কম আমদানি করে। আমদানির ক্ষেত্রে বেশি শুল্ক আরোপ করেছিল। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে গত বছর বাণিজ্য–ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের পক্ষে আছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক। ’
বিজিএমইএ-এর এই সাবেক পরিচালক বলেন, শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ায় দরকষাকষির সময় পাওয়া গেল। এটা সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত। আমরা বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু কত কমাব? বাংলাদেশের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু আছে, এটা তুলে ধরব।
যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত কলা হন্ডুরাস থেকে যায়। এখন হন্ডুরাসকে যদি সেখান থেকে পণ্য আমদানি করতে হয়, তাহলে কত করবে? তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কীভাবে কমাবে? বাংলাদেশেরও একই অবস্থা। ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, এটা বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। এ বৈষম্য নীতি থেকে বের হয়ে এসে তারা ভালো একটি নীতিতে যাবে। তিন মাস সময়ে সেই সুযোগটা পাওয়া যাবে; বলেন এই উদ্যোক্তা নেতা।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন তেল, তুলাসহ যে পরিমাণ পণ্য বাংলাদেশে আমদানি হয়, তার পুরোটাই হয় শুল্কমুক্ত। কিন্তু আমরা ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। এখন তিন মাসের জন্য স্থগিত হওয়ার পরও ২৬ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। বিষয়টি সেইভাবেই আলোচনা করতে হবে। সুচিন্তিতভাবে নেগাসিয়েশন করতে হবে। এই তিন মাসে আমরা মনে করছি, একটি ভালো ফল পাব।
শোভন ইসলাম আরও বলেন, আমাদের ওপর শুল্ক বাড়বে কিন্তু আমদানি হওয়া, জাহাজে থাকা ও উৎপাদনে থাকা পণ্যের ওপর শুল্ক বসানো আমাদের ওপর যেমন ধাক্কা ছিল, আমাদের ক্রেতাদের ওপরও ধাক্কা ছিল। অর্ডার বাতিল হতো বা ডিসকাউন্ট দিতে হতো। তিন মাস সময় পেলাম, আমরা সেই জায়গা থেকে বের হতে পারব। এই তিন মাসে বিচক্ষণতার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআর-এর সঙ্গে বসতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধানী পর্যায়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমরা আশা করি, ভালোভাবে আলোচনা করতে পারলে একটি নিম্ন পর্যায়ের শুল্ক নিশ্চিত করা যাবে। ২৬ শতাংশের বেশি হলে আমরা টিকতে পারব না।
শুল্ক স্থগিতের তিন মাস সময় আমাদের ব্রিদিং স্পেস। যে করেই হোক আমাদের একটি ভালো রেজাল্ট দেখাতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে দুই পর্যায়ে নেগোশিয়েন করে দেখাতে হবে। প্রথমত, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পথে থাকা স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে আমাদের প্রতি সুনজর দেওয়া। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, রপ্তানি করা পণ্যের কমপক্ষে ২০ শতাংশ আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশের এত আমদানি করা সম্ভব হবে না, তবে ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করব। তিন মাস সময় কোনোভাবেই ছোট্ট করে দেখার সুযোগ নেই। সরকার যেমন তিনদিনের মধ্যে চিঠি দিয়েছিল, সেই গতিটা ধরে রেখে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। এটা কার্যকর থাকলে তিন মাস সময়ে বাড়তি ৭২০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক দিতে হতো উল্লেখ করে শোভন ইসলাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অফিস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সময় মতো চিঠি দিয়েছে। ৯০ দিন স্থগিত করতে বলেছে, এ অনুরোধে হয়তো কিছু হয়নি। কিন্তু আমরা পরিস্থিতি বিবেচনার তালিকায় গেছি। তারপর সঠিকভাবে নেগোশিয়েশন করব।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় শুল্ক বহির্ভূত বিষয় উঠে আসবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছারও দরকার আছে, আবার ব্যবসায়ী কমিনিউনিটিরও দরকার আছে। যেমন করেই হোক আমেরিকার যে শুল্কগুলো আছে, সেগুলো রিভিউ করে এবং সার্ভে করে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। তিন মাসের মধ্যে অগ্রগতি কতটা করতে পারছি, তা যুক্তরাষ্ট্র দেখবে। আমাদের কিছু বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা আছে। আমাদের লেবার সমস্যা আছে। বাংলাদেশে আবার নতুন করে ‘জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে’, এমন ধারণা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করেছে একটি বড় দেশ। সেখানকার ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন বোঝা যাচ্ছে। এটা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র কথা তুলতে পারে। কেএফসিতে যে ঘটনা ঘটলো, ঘটনাটি পশ্চিমা গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। এগুলোও মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০২৫
জেডএ/এমজেএফ