ঢাকা: যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে তিন মাসের জন্য ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত করায় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এ সময়ে কমেছে নতুন কার্যাদেশ, চলমান ১০ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে দিতে হচ্ছে মূল্যছাড়।
তবে এর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি। চীনের সঙ্গেবাণিজ্য যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা এখন বাংলাদেশের বাজারের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। অন্যদিকে চীনের ব্যবসায়ীরাও তাদের অর্ডার বাংলাদেশে দিতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বহুল আলোচিত বাড়তি শুল্ক আরোপ করার পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত ৭ এপ্রিল ৯০ দিনের জন্য তা স্থগিত করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। এই তিন মাস—এপ্রিল, মে ও জুনে রপ্তানিতে বাড়তি শুল্ক গুনতে হচ্ছে না। পরবর্তী তিন মাসে উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আগেই প্রাথমিক কার্যাদেশ পেয়েছিল। এখন চূড়ান্ত কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু ক্ষেত্রে শর্তযুক্ত কার্যাদেশ দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত হওয়ার পরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কার্যাদেশ কমে যাবে। এতে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসের উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে। ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত করা হলেও ২৭৫ মিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ কমে যাবে। এর বাইরে ১০ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে বাড়তি ছাড় গুনতে হচ্ছে আরও প্রায় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। শুল্ক স্থগিত হলেও প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি গুনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিত হলেও তৈরি পোশাক উদ্যোক্তারা তিন মাস সময় পাচ্ছি না। এরমধ্যে জাহাজিকরণ থেকে সেখানকার কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ দিন চলে যাবে। আমরা সময় পাব সর্বোচ্চ এক মাস। এরপর যে পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে, তা ৯০ দিন পরে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাবে, আর ৯০ দিন পর যে ব্যবস্থা চলমান থাকবে, তা কার্যকর থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক প্রত্যাহার হলে বাড়তি কোনো শুল্ক লাগবে না। যদি আলোচনায় সমাধান না হয় তাহলে বাড়তি শুল্ক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত হলেও বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক রয়ে গেছে। ক্রেতাদের ১০ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে তিন মাস সময়ের জন্য ৫ থেকে ২০ শতাংশ মূল্যছাড় দিতে হচ্ছে। এ মূল্যছাড় যোগ করে ক্রেতারা পিও (পারচেজ অর্ডার) আপডেট করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্রেতা এটা করছেন।
শোভন ইসলাম বলেন, এ সময়ে কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ বাতিল করেনি। কিন্তু ৯০ দিন পর নতুন করে কী হবে, সেটার জন্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা সেখানে গেছেন। তারা এই অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহারের ব্যাপারে আলোচনা করছেন, আশা করি একটি ভালো ফল পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, চলমান যে কার্যাদেশ আছে, সেগুলোতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে কার্যাদেশ, বিশেষ করে অটাম-হলিডের (শরৎকাল) কার্যাদেশগুলো নিয়ে তারা এখন সতর্ক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। চূড়ান্ত কার্যাদেশ দিচ্ছে না, তারা একটু সময় নিচ্ছে। জুলাই-অক্টোবর মাসে যেগুলোর কাজ হয়, সেগুলোর কার্যাদেশ এই সময়ে দেয়। এগুলো আগে থেকে আমাদের প্রজেকশন দিয়ে দিয়েছিল। তৈরি পোশাক শিল্পে বাড়তি ১০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর আছে, যুক্তরাষ্ট্র এটা বাতিল করেনি। এ জন্য শুল্ক স্থগিত হওয়ায় আগামী তিন মাসের জন্য বায়াররা মূল্যছাড় নিচ্ছে।
এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ আট বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর বাইরে আরও যেসব পণ্য আছে, তা খুবই সামান্য। আর তৈরি পোশাকই দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। তাই তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অনিশ্চয়তায় বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট একেএম সাইফুর রহমান ফরহাদ বাংলানিউজকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক প্রবেশের ক্ষেত্রে আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করায় অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তুলনামূলক ছোট ক্রেতারা। তারা কার্যাদেশ চূড়ান্ত না করে বাতিল বা স্থগিত করছেন। এ ধরনের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের মোট ক্রেতার ৪০ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তুলনামূলক বড়, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
তিনি বলেন, বড় বড় ক্রেতারা যাই বলুক পোশাক নিতেই হবে। সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখতে হলে পোশাক সরবরাহ করতে হবে। আর এজন্য বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক নিতেই হবে। তা না হলে তাদের ওয়্যার হাউজ খালি থাকবে। তারা মনে করছে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ওপর শুল্ক যতই বেশি হোক, চীনের চেয়ে বেশি না। ফলে বাংলাদেশই তাদের ভালো গন্তব্য হবে।
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে। এ সময় বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চীনের পণ্যের ওপর অস্বাভাবিক শুল্ক আরোপ করার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে। দেশটির যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কখনো ব্যবসা করেনি, তারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্যাটার্ন, পরিবেশ ও উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের চাহিদার ১০ ভাগ রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আর চীন রপ্তানি করে ২০ ভাগ। চীন থেকে পণ্য আমদানি করা ক্রেতারা বাংলাদেশের খোঁজ খবর নিচ্ছে।
এ বিষয়ে সাইফুর রহমান বলেন, চীন থেকে আমদানি করা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বুঝে গেছেন, দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হবে না, দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। এ সময়ে সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখার জন্য মধ্যবর্তী সুবিধাজনক কোনো দেশে যাওয়া যায় কি না, তারা ভাবছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের সবচেয়ে ভালো বিকল্প। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে না জানা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আমাদের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছেন, আমরাও তথ্য দিচ্ছি। এতে আমাদের জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাসের বিজনেস কাউন্সিলকে আরও বেশি সক্রিয় করা। যার মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেটে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা তুলে ধরবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনের ক্রেতারাও যুক্ত হয়েছেন। তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে না। চীনের ক্রেতারা তাদের অর্ডার বাংলাদেশে দিতে চায়, যা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হবে। ফলে এই যুদ্ধে বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই, বরং আরও বাড়বে। কিন্তু আমাদের সেই সক্ষমতা নেই। ধরুন, চীন রপ্তানি করে ১৩৭ বিলিয়ন ডলার, আর আমরা রপ্তানি করি শুধু ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এর থেকে চীন যদি ১০ শতাংশ ব্যবসাও স্থানান্তর করতে চায়, এই ১৩ বিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি আমাদের ধারণ করার সক্ষমতা নেই। বর্তমান ক্যাপাসিটিতেই যদি বন্দর সেবা দিতে না পারে, আমদানি রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা থাকে, ঈদে একটু বাড়তি চাপ সামলাতে না পারে, তাহলে চীন থেকে বাড়তি ব্যবসা এলে কীভাবে সামলাবে, বলেন বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েনের এই নেতা।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, বাংলাদেশ সম্পর্কে চীনা ক্রেতাদের ভালো করে বোঝানোর কাজ চলছে। উৎপাদনের সঙ্গে সীমাবদ্ধতার সমাধানের উদ্যোগ, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে।
বাড়তি শুল্ক আরোপ, আবার তা স্থগিত রাখা এবং দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে কার্যক্রম চলছে, অনেক রপ্তানিকারক ও বায়িং হাউজ চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছ থেকে সরে আসবে, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে বলে উল্লেখ করেন সাইফুর রহমান।
তিনি বলেন, একবার যদি বায়ার চলে যায়, তাদের আবার দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। শুল্ক স্থগিতের ৯০ দিন পার হলেও আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব না, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে আলোচনা হচ্ছে, তাতে আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকব। মাঝখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ছাড়া যাবে না, তাদের এন্টারটেইন করতে হবে।
জেডএ/এমজেএফ/জেএইচ