ঢাকা: আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বাজেটে পুঁজিবাজারকে বিশেষ গুরুত্ব দেবে অন্তর্বর্তী সরকার-এমনটাই প্রত্যাশা বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টদের।
৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল ইতিবাচক ধারায় ফিরবে দেশের পুঁজিবাজার। কিন্তু নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ব্যর্থ হয়েছে। সূচকের টানা পতনে আস্থা সংকটে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নানা সংস্কার নিলেও কোনো সংস্কারই কাজে আসেনি।
পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরেই মৌলভিত্তিসম্পন্ন, লাভজনক ও স্বচ্ছ কোম্পানির অভাবে ভুগছে। এর ফলে বাজারের গভীরতা অত্যন্ত সীমিত, যা দীর্ঘমেয়াদে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। বাংলাদেশে বহু লাভজনক দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, যাদের ব্যবসা শক্তিশালী এবং আয়ও উল্লেখযোগ্য। তাই এই সকল কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এবং বিনিয়োগকারীদের কয়েকটি সংগঠনের তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান ১০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল। যার প্রেক্ষিতে ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এটি সাড়ে ৭ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২৪ সালের অর্থ আইন-এর তফসিল (২), অনুচ্ছেদ (খ) এর দফা (ক) এর (অ) অনুযায়ী বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার সাড়ে ২২.৫ শতাংশ এবং বর্ণিত অনুচ্ছেদ ও দফার (ক) এর (ঈ) অনুযায়ী অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার সাড়ে ২৭.৫ শতাংশ। তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারে এই ব্যবধান মাত্র ৫ শতাংশ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে পুঁজিবাজারের ভাগ্য। তাই পুঁজিবাজারবান্ধব বাজেট প্রত্যাশা করছেন বিনিয়োগকারীরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পুঁজিবাজারবান্ধব হবে বলে আমরা মনে করি। যা পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান ১০ শতাংশ করা হলে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে। এতে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি পাবে বলে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস।
এদিকে দেশি, বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যাতে পুঁজিবাজার হতে মূলধন উত্তোলনে উৎসাহিত হয় সেজন্য কর সুবিধা প্রদান আবশ্যক, যা প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ নানাবিধ খরচ বহন করতে হয় বিধায় তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের মধ্যে করহারের ব্যবধান পূর্বের ন্যায় সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ করার জন্য অনুরোধ করে বিএসইসি। এই পদক্ষেপ পুঁজিবাজারে গুণগতমানসম্পন্ন কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, বাজারকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল ও স্থিতিশীল করে তুলবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের আর্থিক খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
অন্যদিকে আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। সম্প্রতি তিনি এক বৈঠকে বলেন, সরকার পুঁজিবাজার এবং বিনিয়োগকারীদের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। বিনিয়োগকারীদের মতামতগুলো নিয়ে সরকার কাজ করবে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। আগামী বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নিম্নে স্টেকহোল্ডারদের বাজেটের সুপারিশগুলো তুলে ধরা হলো-
ডিএসইর বাজেট প্রস্তাবনা
পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। সুপারিশগুলো হলো-শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মধ্যেকার করপোরেট কর হারের ব্যবধান বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের বাজারে ধরে রাখতে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর লেনদেনের ওপর থেকে ১ লাখ টাকার বিপরীতে অগ্রিম আয়কর ৫০ টাকার পরিবর্তে ১৫ টাকা করা, সব ধরনের বিনিয়োগকারীর মূলধনি মুনাফাকে করমুক্ত করা, এক লাখ পর্যন্ত লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত করা, এক লাখ-পরবর্তী লভ্যাংশ আয়ের ওপর আরোপিত করকে চূড়ান্ত দায় হিসেবে ঘোষণা করা।
সিএসইর বাজেট প্রস্তাবনা
এদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে আসন্ন প্রস্তাবিত বাজেটে। সেগুলো হলো—কমোডিটি এক্সচেঞ্জকে ৫ বছরের জন্য কর অব্যাহতি প্রদান করা, লভ্যাংশ করের ওপর দ্বৈত করের বিধান প্রত্যাহার করে লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত ঘোষণা করা, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হারের ব্যবধান ন্যূনতম ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা, এসএমই ও অল্টারনেটিং ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহকে প্রথম তিন বছরের জন্য কর অব্যাহতি দেওয়া, জিরো কুপন বন্ডের মতো অন্য বন্ডগুলি (কর্পোরেট বন্ড, সরকারি সিকিউরিটিজ ইত্যাদি) হতে উদ্ভূত আয়কেও কর অব্যাহতি দেওয়া, স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যদের নিকট থেকে উৎসে আয়কর কর্তনের হার পূর্ববর্তী ০.০১৫ শতাংশ পুনঃনির্ধারণ করে এ রূপে কর্তিত করকে ব্রোকারেজ ব্যবসা হতে উদ্ভূত সমুদয় আয়ের জন্য চূড়ান্ত করদায় বিবেচনা করা, ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা, যেসব দেশের সাথে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি বিদ্যমান আছে সেসব দেশের কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত পরামর্শ বা কনসালটেন্সি সেবা, কারিগরি বা টেকনিক্যাল সেবা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্সের ওপর উৎসে কর কর্তনের বিধান রাজস্ব বোর্ডের কোনো রূপ সনদপত্র ছাড়া প্রত্যাহার করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা সম্পদ ব্যবস্থাপক কর্তৃক ইস্যুকৃত ইউনিট সার্টিফিকেট এবং মিউচুয়াল ফান্ডের সর্বোচ্চ সীমা ৫ লাখ টাকা উঠিয়ে দেওয়া।
ডিবিএ’র বাজেট প্রস্তাবনা
আসন্ন বাজেটকে কেন্দ্র করে ডিবিএর পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। প্রস্তাবগুলো হলো—কোম্পানি ব্যতীত অন্যান্য করদাতার ক্ষেত্রে লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ চূড়ান্ত কর ধার্য করা, কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তি কর্তৃক অর্জিত মূলধনী আয় তার প্রারম্ভিক ইক্যুইটির ২০ শতাংশ অথবা ৫০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেটাই মূলধনী আয় করমুক্ত সীমা নির্ধারণ, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোনো সিকিউরিটিজ অথবা বিএসইসি কর্তৃক অনুমোদিত কোনো মিউচ্যুয়াল ফান্ড বা তহবিলের ইউনিট লেনদেনের মাধ্যমে মূলধনী ক্ষতির সমন্বয় বা জের টানার বিধান রাখা, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সিকিউরিটিজ লেনদেনের মূল্য পরিশোধকালে ০.০২ শতাংশ হারে কর সংগ্রহ করা, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা সম্পদ ব্যবস্থাপক বা ফান্ড ম্যানেজার কর্তৃক ইস্যুকৃত ইউনিট সার্টিফিকেট এবং মিউচুয়াল ফান্ড ইটিএফ বা যৌথ বিনিয়োগ স্কিম ইউনিট সার্টিফিকেটে যেকোনো পরিমাণ অর্থের বিনিয়োগ থাকলে কর রেয়াত সুবিধা প্রদান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের অধীনে পরিচালিত কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে তালিকাভুক্ত শেয়ার বা স্টক/মেয়াদী মিউচ্যুয়াল ফান্ড/ট্রেজারি বন্ডসহ যেকোনো সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ থাকলে কর রেয়াত সুবিধা প্রদান, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংরক্ষিত আয়, সঞ্চিতি, উদ্বৃত্ত ইত্যাদির ওপর কর আরোপ প্রত্যাহার ও তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হারের ব্যবধান ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা।
এসএমএকে/এসআইএস