ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বদলে যাচ্ছে দিনাজপুর

গবাদি পশু পালনে ৭ হাজার নারী স্বাবলম্বী

মাহিদুল ইসলাম রিপন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৬
গবাদি পশু পালনে ৭ হাজার নারী স্বাবলম্বী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দিনাজপুর: দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম গণিপুর। আর দশটা গ্রামের মতোই সাধারণ এক গ্রাম।

এই গ্রামেরই একটি কুঁড়েঘরে আকলিমার (৩২) স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে ছোট সংসার।

স্বামী সামসুদ্দিনের দিনমজুরির টাকা দিয়ে খুব কষ্টে দিনানিপাত হয় তাদের। দরিদ্রতা সংসারের সর্বত্র। এমনকি আর্থিক সংকটের কারণে ছেলে সোহেল (৭) ও মেয়ে শারমিন আক্তারকে (৫) স্কুলেও পাঠাতে পারেননি তারা।

একসময় তাদের মনে হয় এ কষ্টের বুঝি শেষ নেই। এরপর একদিন যাদুমন্ত্রের মতো আকলিমা খুঁজে পান অবলম্বন। এখন সেই আকলিমা সাবলম্বী। পরিবারের তার আর অভাব নেই। ছেলে-মেয়েও যাচ্ছে স্কুলে।

এই আকলিমার মতো দিনাজপুরের আরো ৭ হাজার আকলিমা এখন স্বাবলম্বী। তাদের হাত ধরেই বদলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

কিভাবে আকলিমাদের জীবনে এলো এমন পরিবর্তন। বাংলানিউজকে আকলিমা জানান তার সেদিন-এদিনের আদ্যপান্ত।

তখন, ২০১০ সালের জুন মাস। হতদরিদ্র নারী অর্থনৈতিক সম্পদ বঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (আমাদের) নামে একটি প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন আকলিমা।

ওই প্রকল্প থেকে তাকে প্রথমে ১টি গরু, ১টি ছাগল, ৩টি হাঁস ও ৩টি মুরগি দেওয়া হয়। এসব গৃহপালিত পশু-পাখি ৩ মাস ধরে পালন করেন তিনি। এরপর গরু বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে তৈরি করেন টিনের ঘর। কেনেন আরো ১টি গরু।

এর ৪ মাস পর আবারো গরু বিক্রি ও স্বামীর দিনমজুরির টাকা দিয়ে প্রতিবেশীর ১৫ কাঠা ধানের জমি চুক্তিতে নেন। সেই জমিতে চাষ করে ৩০ মণ ধান পান আকলিমা।

ধান বিক্রির টাকা; সেইসঙ্গে ছাগল, হাস ও মুরগি পালন বাবদ আসা টাকা দিয়ে ঘুরতে শুরু করে আকলিমার সংসারের চাকা, ভাগ্যেরও।

এভাবেই বদলে যায় আকলিমার জীবন। সংসারের অভাব দূর হয়েছে তার। ছেলে-মেয়ে এখন পাশের গণিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় নিয়মিত।

সরেজমিনে দিনাজুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, শুধু আকলিমাই নয়, দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর ও ফুলবাড়ীসহ জেলার ৭টি উপজেলার ৪১টি ইউনিয়নের হাজারো নারী এভাবে সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।

এসব এলাকার মাজেদা বেগম (৪২), দুলু বালা (৫৫), বিদ্যা রানী (৬৫), বুলবলি (৪৭), শান্তি বালার (৫০) মতো অন্তত ৭ হাজার ১৭৫ জন হতদরিদ্র নারী অর্থনৈতিক সম্পদ বঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (আমাদের) প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। নিজেদের পাশাপাশি পরিবারের অনান্য সদস্যদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন তারা। তাদের হাত ধরেই অনেকটা বদলে গেছে দিনাজপুর।

আকলিমার মতো স্বাবলম্বী হওয়া আরেক নারী চিরিরবন্দর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের মৃত বিনয় কুমার রায়ের স্ত্রী বিদ্যা রানী।

তিনি বলেন, ‘হামার স্বামী মরি যাওয়ার ১০ বছর খুব কষ্টত কাটিছে। মোর একমাত্র ছইলটাও তখনকা ছোট। কি করি মানুষ করিম। মাইনষের বাড়িত কাজ করি তায় ছইল নিয়া কোনোমতে দিন কাটাসুনু। বছর পাঁচেক আগত হামার এই ছুইলেরা (প্রকল্পের কর্মকর্তারা) হামাক একটা গরু, ছাগল, আর হাস-মুরগি দিয়া যায়। তারপর এইটাই পালন করিয়া কিছুদিন মাইনষের বাড়িত কাজ করার লাগছিলো। তারপর এগুলা দিয়া এখন মোর ঘর-বাড়ি সব কিছু হইছে তোমার দোয়াতে। মুই একটি মাচা দিয়া লাউ চাষ করছি। ১৫ দিন আগত ৩ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করিছি। আরো ২ মাস লাউ বিক্রি করা যাবে। ’

জানা গেছে, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ২০০৮ সালে ৮শ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি একনেকে পাস হয়। এরপর সারাদেশে একযোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষে ২০১০ সালের মে মাসে নেটজ বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় ডিএফআইডি ইইপি/সিঁড়ি, এসডিসির অর্থায়নে দিনাজপুরের পল্লীশ্রীর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়।

গত ৫ বছরে মোট ১১৮ জন কর্মী অক্লান্ত পরিশ্রম করে হতদরিদ্র নারীদের পর্যবেক্ষণ ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

কথা হয় ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নবীউল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, এ প্রকল্প ‍এলাকার নারীদের সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। তিনি সরকারের প্রতি এ রকম প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদী করার ‌‌আহ্বান জানান।

নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউপি সদস্য শাহিনুর ইসলাম সারোয়ার জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকার অনেক পরিবার এখন দুইবেলা খেতে পারে।

হতদরিদ্র নারী অর্থনৈতিক সম্পদ বঞ্চিত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন (আমাদের) প্রকল্পের দিনাজপুর অঞ্চলের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মোস্তফা কামালের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, প্রকল্পটি মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষে দিনাজপুরের স্থানীয় সংস্থা পল্লীশ্রীকে ২০ কোটি ৫৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৬৩ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারা ৭টি উপজেলার ৭ হাজার ১৭৫ জন নারী ও তাদের পরিবারকে এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলেছে।

এ জন্য পল্লীশ্রী থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৫১ জন ফুলটাইম ও ৬৭ জন পার্টটাইম কর্মী প্রকল্পের সদস্যদের পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন। আমাদের কাজের মাধ্যমে ৭ হাজার ১৭৫ জন হতদরিদ্র নারীকে স্বাবলম্বী করতে পারায় ভালো লাগছে। এই প্রকল্প অতিদরিদ্র মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের একটি মডেল।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৬
এসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।