ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

চালনার হ্যাচারিতে চিংড়ি ফোটে কোটি কোটি

জাহাজে আসে নোনা জল, বিমানে চেপে ডিম

মাহমুদ মেনন ও মাহবুবুর রহমান মুন্না | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৬
জাহাজে আসে নোনা জল, বিমানে চেপে ডিম ছবি: মানজারুল ইসলাম- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা : নোনাপানি বয়ে আনা হয় গভীর সমুদ্র থেকে বড় জাহাজে করে। ওদিকে কক্সবাজার থেকে চাটার্ড কার্গোবিমান যোগে আসে ডিমের চাক।

যশোর থেকে সে ডিম দ্রুত নিয়ে আসতে হয় অতি সাবধানে। তুলে আনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্লোরিনমুক্ত লবনাক্ত ফটিক জলে ছাড়তে হবে সে ডিম। যে বিশাল চৌবাচ্চায় ছাড়া হবে ডিম, তাতে তুলতে হবে সমু্দ্রের মতো ঢেউ। পানি থাকবে সদা সচল। আর তাতে ডিম ছেড়ে রেনু ফুটবে। কোটি কোটি রেনু থেকে হবে চিংড়ি। নোখের চিমটিতে ধরা যাবে এমন চিংড়ি পোনা চৌবাচ্চা থেকে তুলে বিক্রি হবে। আর তা নিয়ে ছাড়া হবে ঘেরে। সেই চিংড়ি বড় হবে। হয়ে উঠবে সাদা সোনা। বিক্রি হবে কেজি দরে। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।
 
খুলনার দাকোপের চালনায় পশুর নদীর তীর ঘেঁষে রেড স্টার হ্যাচারিতে এই কর্মযজ্ঞই দেখা গেলো। ভেতরে ঢুকে মনে হলো সে এক এলাহি কাণ্ড। বড় বড় চৌবাচ্চায় পানিতে ঢেউ উঠেছে। চার দেয়ালের ভেতরেই এক সমুদ্র আয়োজন। এখানে বাগদা চিংড়ির রেনু ফোটানো হয়। সমুদ্রের নোনা জল ছাড়া যা ফোটানো সম্ভব নয়।

আড়াই একর জমিতে ১০০ ট্যাংকি তৈরি করে এ হ্যাচারি চলছে। এছাড়া রয়েছে কয়েক শ’ ছোট ছোট চৌবাচ্চা।

সমুদ্রের পানির সঙ্গে যে অন্যান্য জীব চলে আসে সেগুলোকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা হয়। আর সেগুলোই হয়ে ওঠে চিংড়ির পোনার খাদ্য।

ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর ২০ থেকে ২২ দিন নার্সিং করে তা বিক্রির উপযোগী করে তোলা হয়। সব মিলিয়ে একটি পুরো সার্কেল শেষ হতে মাস খানেক সময় লাগে।

গভীর সমুদ্র থেকে খাটি লবনাক্ত পানি তুলে তা বড় জাহাজে করে বয়ে এনে সেখান থেকে পাইপ যোগে টেনে এনে ভরিয়ে তোলা হয় চৌবাচ্চা ও ট্যাংকিগুলো। সেই পানি পরিষ্কার করে তোলাই হয়, তখন প্রধান কাজ। বিভিন্ন ধরনের মেডিসিন ব্যবহার করে আর পানির ভেতর কৃত্রিম ঢেউ তুলে পানি পরিষ্কার করে তোলা হয়। ব্লিচিং পাউডার, চুন, সোডিয়াম কার্বোনেট মিশিয়ে টানা ঢেউ তুলতে থাকলে সে পানি ক্লোরিন মুক্ত হতে থাকে। এরপর চলে ফিল্টারিং প্রক্রিয়া। বালু, কার্বন, পাথরকুচির মধ্য দিয়ে চুইয়ে সে পানি ফিল্টার করে রাখা হয় অন্য চৌবাচ্চায়। এক পর্যায়ে তা ফটিক জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তবে সে পানিতে থাকতে হবে অন্তত ত্রিশ শতাংশ লবনাক্ততা। সেটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে অতিরিক্ত লবন মিশিয়ে দেওয়া হবে।

পানির উষ্ণতাও এখানে একটি বড় বিষয়। ২০-২১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণ না হলে তা চিংড়ি পোনা ছাড়ার উপযোগি নয়, ওটাই সমুদ্রের স্বাভাবিক উষ্ণতা। উষ্ণতা নিশ্চিত করে তবেই ছাড়া হয় চিংড়ির রেনু।

রেড স্টার হ্যাচারির ম্যানেজার শওকতুর রহমান বলেন, সমুদ্রের ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে চিংড়ি ডিম ছাড়ে বাচ্চা ফোটায়, আমাদের এই হ্যাচারিতে কৃত্রিমভাবে তেমনই একটি পরিবেশ, পরিস্থিতি ও অবস্থা সৃষ্টি করতে হয়। এটাই চ্যালেঞ্জ।

এক সার্কেলে এই হ্যাচারিতে ১০ থেকে ১২ কোটি চিংড়ির পোনা উৎপাদন সম্ভব। তবে কখনো কখনো উৎপাদন ৫ কোটিতেও নেমে যেতে পারে। পরে তা হাজার ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। ঘের মালিকরা এর মূল ক্রেতা। হ্যাচারি থেকে কিনে নিয়ে সেই চিংড়ি ঘেরে তিন মাস ধরে বড় করে বাজারে চড়া দরে বিক্রি করেন। এ সময় একেকটি চিংড়ি ৫০ থেকে ৬০ গ্রাম ওজনের হয়। যারা চার পাঁচ বা ছয় মাস পর বিক্রি করেন তাদের চিংড়ি আরও বড় হয়। কোনটি দেড়শ’ দুইশ’ গ্রাম ওজনেরও হয়ে যায়। তখন গড়ে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও ঘের মালিক একেকটি চিংড়ি দেড়শ’ টাকা পর্যন্ত দর ওঠে। সেই হিসেবে ঘের মালিকরা একেকটি চিংড়ি পোনা ৫০ পয়সা দরে কিনে এই বড় অংকের মুনাফা করতে পারেন।

তবে হ্যাচারি মালিকের মুনাফাও কম নয়। ৩০০ টাকা হাজার দরে এক কোটি মাছ ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর এক সার্কেলে ১০ কোটি পোনা উৎপাদন করা গেলে তা তিন কোটি টাকা বিক্রি করা সম্ভব। আর একটি সার্কেল উৎপাদনে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচ হয়।

শওকতুর বলেন, ভাগ্য ভালো থাকলে এক সার্কেলে ২ থেকে ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত আয় আসতে পারে। আবার ভাগ্য খারাপ হলে পুরোটাই ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

সেটা কেনো? এখানে পানির প্রক্রিয়াকরণ বড় চ্যালেঞ্জ, ভুল হয়ে গেলে পুরোটাই মাটি। এছাড়াও চিংড়ি ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারে। তাতে বিশাল ক্ষতি।

‘ চিংড়িরও জ্বর আছে, পায়খানা আছে, এই  আছে, সেই আছে। মানুষের যেমন আছে ওদেরও তেমন আছে। এখানে সতর্কতাটা জরুরি। ’

আমরা চিংড়ির শরীরের ভাষা বুঝতে পারি। অতটুকু রেনু কি অবস্থায় কেমন আছে, দিনে কেমন থাকে, রাতে কেমন, প্রতিটি মূহূর্তেই নজরে রাখতে হয়।

হ্যাচারি ঘুরে ঘুরে এর কারিগরি দিকগুলো বর্ণনা করছিলেন টেকনিশিয়ান ওসমান গনি। তিনি বলেন, একটি হ্যাচারির প্রধান প্রয়োজনীয় হিসেবে দেখা হয়, বাষ্প ও অক্সিজেন উৎপাদনকারী যন্ত্রটিকে। কোটি টাকা মূল্যের অ্যারেটর নামের এই যন্ত্র সারাক্ষণ চলছে, পাইপযোগে পানিতে বাষ্প দিয়ে তৈরি করছে অক্সিজেন, আর সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পানি ক্লোরিন মুক্ত হচ্ছে। সাত দশমিক পাঁচ অশ্ব শক্তির এমন আটটি মেশিন রয়েছে। আর সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করবে, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর বসানো হয়েছে এই হ্যাচারিতে।

আরেকটি প্রধান খরচ রঙে। উন্নত মানের পেইন্ট দিয়ে চৌবাচ্চা ও ট্যাংকিগুলোতে রঙ লাগিয়ে দিতে হয়, যাতে এর স্বচ্ছতা দেখা যায়, আর শ্যাওলাসহ অন্য ময়লা জমে গেলে তা সহজেই ধুয়ে পরিষ্কার করা সম্ভব হয়। বছরে প্রায় দশ লাখ টাকার রঙ খরচ হয় এই হ্যাচারিতে।  

চিংড়ি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য। আর এই পণ্যের গুনগত মানটা নিশ্চিত করা একটা অন্যতম দায়িত্ব। সে কারণেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞ, এত আয়োজন, বলেন শওকতুর রহমান।

চিংড়ির ডিম সংগ্রহও একটি বড় ঝক্কি। সমুদ্রে যে চিংড়ি ধরা পড়ে, তার মধ্যে মা চিংড়িগুলোর পেটে ভরা থাকে ডিম। জেলেদের কাছ থেকে সেই চিংড়ি সংগ্রহ করতে হয়। এমন একটি ডিম ওয়ালা চিংড়ি মাছ কেনা হয় ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে। এটা চিংড়ির মওসুমে। কিন্তু মৌসুম ছাড়া এমন একটি চিংড়ি কিনতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এমন একেকটি চিংড়ি ৮ থেকে ১০ লাখ করে ডিম ছাড়ে। কোনও কোনটির চার-পাঁচ লাখ করেও ছাড়ে। আবার সব মাছ ডিম ছাড়েও না। ১০০টি মাছ কিনলে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি ডিম ছাড়ে। এই ডিম থেকে সবমিলিয়ে ১০ মিলিয়ন বা এক কোটি ডিম থেকে হয়তো বাচ্চা হতে পারে। এই এক কোটি বাচ্চা নিয়েই শুরু হয় একেকটি সার্কেল। কক্সবাজার থেকে কার্গো বিমান চার্টার্ড করে এই ডিম নিয়ে আসা হয়। কক্সবাজার এয়ারপোর্ট থেকে তা নিয়ে আসা হয় যশোরে। সেখান থেকে গাড়িতে করে খুলনার চালনায়। ডিম ছাড়ার পর তা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত পানির বাইরে রাখলেও তা জীবন্ত থাকে। ফলে কক্সবাজার থেকে ডিম তুলে এই সময়ের মধ্যে এনেই পানিতে ফেলতে হবে। সারা বছরই হ্যাচারিতে চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব তবে মাসে একেকটি সার্কেল শেষ করতে পারলেও বছরে পাঁচটি বা ছয়টির বেশি সার্কেল চালানো সম্ভব হয় না।      

১৯৯৪ সাল থেকে রেডস্টার হ্যাচারিটি চলছে। এবং সুনামের সঙ্গেই ব্যবসা করে যাচ্ছে। ভেতরের পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। চারিদিকে চৌবাচ্চায় পানির ঢেউ চোখে পড়বে। আর সেই কৃত্রিম ঢেউ সৃষ্টির জন্য সদাসচল মেশিনের শব্দ। তৈরি হচ্ছে অক্সিজেন, আর তাতেই বাঁচবে চিংড়ির পোনারা। বড় হবে। তারপর ঘেরে নিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক পরিবেশে হয়ে উঠবে আরও বড়, ফলবে সাদা সোনা। বিদেশে রপ্তানি হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে। আর তাতেই দেশ এগিয়ে যাবে।  

বাংলাদেশ সময় ০৯৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৬
এমএমকে

** চাষীর চাষে লজ্জা নেই!
** নারী নির্যাতনা ট্যাংরা মাছ ও এগিয়ে চলার গল্প
** পট পট পট, ফুটছে চাল... হচ্ছে মুড়ি (ভিডিও এক্সক্লুসিভ)
** এ ‘মণিহার’ আমায় নাহি সাজে!

** ধানের ফলনে কৃষকের হাসি, দামে বেজার
** শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন: যশোরের যশ, খেজুরের রস
** শুক্রবারের বিশেষ প্রতিবেদন: ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল’
** সুন্দরবন এক্সপ্রেস থেকে: আউশের চিড়া ও তার কারিগরের গল্প

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।