ঢাকা: বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির শতাধিক আসামি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজরদারিতে রয়েছেন। আসামিদের কেউ যেনো বিদেশ যেতে না পারে সে জন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থাটি।
এছাড়া পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মাধ্যমে বিভিন্ন বন্দরেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। আসামিদের নজরদারিতে রাখতে দুদকের একটি শক্তিশালী ইউনিটের পাশাপাশি একটি গোয়েন্দা সংস্থাও তৎপর রয়েছে। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র এসব বিষয় বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি জানায়, কয়েকজন আসামি গ্রেফতার এড়াতে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন-এমন তথ্যের ভিত্তিতে দুদক মামলার তিনমাস পর সতর্ক অবস্থান নেয়। ইতিমধ্যে বেসিক ব্যাংকের অপসারিত ২ উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে দুদক। মামলার তিন হেভিওয়েট আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
তদন্তের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বাংলানিউজকে বলেন, আইন অনুযায়ী যা করা দরকার তদন্ত কর্মকর্তা তা প্রয়োগ করবেন। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের থানার ওসি’র (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ক্ষমতা রয়েছে। তারা তদন্তের প্রয়োজনে কাউকে গ্রেফতার এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে রিমান্ডে (জিজ্ঞাসাবাদ) আনতে পারবেন।
দুদকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে দুদকের মোট ৫৬ মামলায় ১৫৬ আসামির মধ্যে একশ’র বেশি বিশেষ নজরদারিতে রয়েছেন। যাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আসবে। জানা গেছে, শিগগিরই গ্রেফতারে চিরুনি অভিযানে নামবে দুদকের বিশেষ টিম।
এর আগে কমিশন মামলাগুলো তদন্তের জন্য দুদকের উপপরিচালক মোরশেদ আলম, মো. ইব্রাহিম, ঋত্বিক সাহা ও শামসুল আলম এবং সহকারী পরিচালক ফজলে হোসেন ও উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। এদের তদারককারী কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন পরিচালক নুর আহমেদ ও সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা ৫৬টি মামলার তদন্ত করছে দুদকের এ টিম।
একজন তদন্ত কর্মকর্তা ঊদ্ধৃত না হওয়ার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, আসামিরা যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য গত সপ্তাহে কমিশন থেকে বন্দর, ইমেগ্রিশন কর্তৃপক্ষ, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠাতে বলা হয়েছে।
এদিকে গ্রেফতার অভিযানের প্রথম ধাপে গত বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) রাজধানীর মতিঝিলের সেনাকল্যাণ ভবনের সামনে থেকে বেসিক ব্যাংকের বহিষ্কৃত উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ফজলুস সোবহান ও মোহাম্মদ সেলিম একং উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও গুলশান শাখার ব্যবস্থাপক শিপার আহমেদকে আটক করে দুদকের বিশেষ টিম।
তাদের মতিঝিল ও গুলশান থানার পৃথক দুই দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ওইদিন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসবাদের জন্য দুই মামলায় ৭ দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড চায় দুদক। অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. কাইসারুল ইসলাম তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে আগামী ১১ জানুয়ারির রিমান্ড শুনানির জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন।
প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে গত বছরের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর এ তিন দিনে ৫৬টি মামলা করেছেন দুদকের অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় এসব মামলা দায়ের করে দুদক। ৫৬টি মামলায় মোট আসামি ১৫৬ জন। মামলাগুলোতে মোট ২ হাজার ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামিদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ২৬ জন। বাকি ১৩০জন আসামি ঋণগ্রহীতা ৫৪ প্রতিষ্ঠানের স্বত্ত্বাধিকারী এবং সার্ভে প্রতিষ্ঠানের। ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলায় আসামি হয়েছেন।
ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়। গ্রেফতার হওয়া ডিএমডি ফজলুস সোবহান ৪৭টি, কনক কুমার পুরকায়স্থ ২৩টি, গ্রেফতার হওয়া মো. সেলিম ৮টি, বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খান ৩৫টি মামলায় আসামি হয়েছেন।
ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নীল সাগর এগ্রো ও পারুমা ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউকে বাংলা ট্রেডিং, টেকনো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, শিফন শিপিং লাইন, মা টেক্স, এস রিসোর্সেস শিপিং লাইন, এস সুহি শিপিং লাইন, লিটল ওয়ার্ল্ড লিমিটেড, ফারসে ইন্টারন্যাশনাল, বিএস ট্রেডিং, ডায়নামিক টিস্যু ইন্ডাস্ট্রিজ, ওয়াটার হ্যাভেন করপোরেশন, আজাদ ট্রেডিং, অ্যানজেল অ্যাগ্রো ফিড, প্রাসাদ নির্মাণ, বাবি সুয়েটার্স, দিয়াজ হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, মৌলি ফ্যাশন, এস এল ডিজাইনার, বেনিসন ইন্টারন্যাশনাল, এআরএসএস এন্টারপ্রাইজ, এস অ্যান্ড জে স্টিল, এসএফজি শিপিং লাইন, ইএফএস ইন্টারন্যাশনাল, ধ্রুব ট্রেডার্স, আজবিহা অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, বর্ষণ অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, অনলাইন প্রপার্টিজ, রূপায়ন হাউজিং এস্টেট, ইয়ুথ অ্যাগ্রো ফার্ম, রাসু ইন্টারন্যাশনাল, আরআই এন্টারপ্রাইজ, এক্সিভ ট্রেড, হার্ব হোল্ডিংস, হাসিব এন্টারপ্রাইজ, হক ট্রেডিং, রুদ্র স্পেশাইলজড কোল্ড স্টোরেজ, গুঞ্জন অ্যাগ্রো এরোমেটিক অটোরাইস মিল, এলআর ট্রেডিং, টেলিউইজ ইন্টারন্যাশনাল, বেনিকো সোলার এনার্জি এবং ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের স্বত্তাধিকারী নজরদারিতে রয়েছেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের বিরুদ্ধেও দুদকের গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে গ্রেফতার হওয়া তিন কর্মকর্তার আদালতের অনুমতিক্রমে সোমবার থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে রিমান্ড শুরু হবে। দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
এডিএ/জেডএম