সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্পন্ন গবেষণার সংখ্যা খুবই কম। যা আছে তাও পুরনো ধাঁচের।
ইউজিসি সূত্র বলছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষক কিংবা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিজেরাই গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ভালো করছেন, অনেকে আবার জনকল্যাণে অবদান রাখতে পারছেন না। আর যেসব গবেষণা হচ্ছে তা ফলপ্রসু, এমনকি তা জাতীয় পর্যায়ে কাজে আসছে না। আর ব্যর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণেও।
কর্মকর্তারা বলছেন, গবেষণাখাতে প্রতিবছরই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজেটের বরাদ্দ বাড়ানো হয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা স্তরে এ খাতে সেই অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রতিবছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে গবেষণাপ্রস্তাব এবং গবেষণাপত্র পাই। যার অনেকগুলোই মানসম্পন্ন নয় বা অগ্রহণযোগ্য। আবার অনেকগুলো প্রচলিত বিষয়ের ওপর, নতুন কিছু তেমন পাওয়া যায় না।
ইউজিসি সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২ কোটি টাকা বেশি। এরপরও সেভাবে গবেষণাখাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই একটি বিস্তৃত গবেষণা নীতিমালা তৈরি করতে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি। সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রথম বৈঠকে কমপক্ষে ১৮টি প্রস্তাব কমিটির কাছ থেকে পেয়েছে ইউজিসি। এসব প্রস্তাবে ফলপ্রসূ গবেষণা প্রকল্পগুলোতে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মানুষের উপকারে আসবে, সমস্যার সমাধান করবে- এমন সব গবেষণায় সহযোগিতা ও অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করেছে কমিটি।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিল্পে যৌথভাবে সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া গবেষণাপত্র প্রকাশ বা উদ্ভাবণের বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি গবেষণার পেটেন্ট অর্জন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালগুলোতে ইউজিসির অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়ারও প্রস্তাব দেন তারা।
এছাড়া এসব গবেষণায় উৎসাহী করতে প্রণোদনা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদত হোসেন বলেন, মানসম্পন্ন গবেষণা ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যেতে পারে না। আমাদের অনেক শিক্ষকই গবেষণা করেন। কিন্তু ডেটাবেস না থাকায় তা যথাযথভাবে প্রকাশ পায় না।
‘আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের গবেষণাকে পেটেন্ট করার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে রয়েছি। আমরা আমাদের গবেষণায় আউটকাম বা উদ্ধাবিত বিষয়াবলী বাণিজ্যিকীকরণেও ব্যর্থ হচ্ছি। এক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা কাজের এই প্রচলিত পদ্ধতির পুনঃবিন্যাস করা প্রয়োজন। এছাড়া গবেষণার জন্য বিস্তৃত নীতিমালাও দরকার। ’
ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সুইডেন, ডেনমার্কের দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা তাদের গবেষকদের কীভাবে প্রণোদনা দেয়, উৎসাহিত করে। আর সেটা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকেই। এজন্যই ওইসব দেশ এগিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে গবেষণার বিস্তৃতি বাড়াতে ইউজিসির উদ্যোগের কথা জানিয়ে অধ্যাপক ড. শাহাদত হোসেন বলেন, বিস্তারিত একটি নীতিমালা তৈরিতে ইউজিসি উদ্যোগী হয়েছে। এটা খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ ইউজিসি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের এ জাতীয় কোনো নীতিমালা তৈরি হয়নি।
এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য ও প্রখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বর্তমানে আমাদের গবেষণাগুলো জাতীয় চাহিদা বা সমস্যার কথা তুলে ধরছে না। মানুষের কল্যাণে কাজে আসছে না। এ জাতীয় গবেষণা আন্তর্জাতিক মান অনুসারে শিক্ষার মানও বাড়াতে অবদান রাখছে না। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত আমাদের কোনো গবেষণা নীতিমালাও নেই।
‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগতমান তার গবেষণার মান দিয়ে বিবেচিত হয়। দেশ ও বৈশ্বিক প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে এবং নতুন নতুন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করে। এটা করতে হয় মানসম্পন্ন গবেষণার মাধ্যমে। ’
গবেষণা নীতিমালার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পেয়েছি। এগুলো আমাদের একটি বিস্তৃত ও যুগোপযোগী গবেষণা নীতিমালা তৈরিতে কাজে দেবে।
গবেষণা উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ড. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য অর্থায়ন করতে। ইউজিসিও সেভাবে কাজ করতে চায়। এক্ষেত্রে আমরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে মানসম্মত এবং আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা চাই।
‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ সঙ্কট রয়েছে। আমরা এর থেকে উত্তরণ চাই। এজন্য আমরা ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও নেবো। ’
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেতে পারে আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি। এজন্য আমাদের দরকার মানসম্পন্ন গবেষণা। যে নীতিমালা করতে যাচ্ছি তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান বাড়ানোর পথ তৈরি করে দেবে বলে আমরা আশাবাদী।
‘বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা কাজের মাধ্যমে পেটেন্ট অর্জন করছে। এক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পেটেন্টের সংখ্যা মাত্র মাত্র ১০টি। একুশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে,’ যোগ করেন এই গবেষক।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১৯
এমএ/