সিলেট: নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ‘নখদন্তহীন বাঘ’ মন্তব্য করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন সিলেট-৩ আসনের ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল। মাঠপর্যায়ের নির্বাচনী কর্মকর্তারা ইসির কোনো আদেশ মানেননি।
ডা. দুলাল বলেন, ভোটে এই জালিয়াতির মহোৎসবে আমার নির্বাচন করার প্রয়োজন রয়েছে মনে করি না। ভবিষ্যতেও কোনো নির্বাচনে অংশ নেবো বলে মনে হয় না। এ ধরনের নির্বাচন জাতীয়ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও মনে করে না। তবে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি, নির্বাচন কমিশনের হুমকি-ধামকি দেখে, কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল তারা কি একটা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার আসনে মনে হয়েছে ইসি ‘নখদন্তহীন’ বাঘের মতো, তারা শুধু হুঙ্কার দিতে জানেন।
রোববার (০৭ জানুয়ারি) বিকেলে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে সিলেট-৩ আসনে ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল আরও বলেন, আপনারা জেনে অবাক হবেন, নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে কিভাবে এক হাজার ভোট গণনা হয়ে যায়, কোন প্রতীকে কতটা ভোট পড়েছে, অবাক হচ্ছি। এর অর্থ হলো, এগুলো ফরমায়েশি রেজাল্ট দেখানো হচ্ছে।
ইসির সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের বৈষম্যের তীব্র নিন্দা জানান তিনি।
নির্বাচনী মাঠের পরিস্থিতি তুলে ধরে ডা. দুলাল বলেন, নির্বাচনের দিন প্রথম প্রহরটি ভালো কেটেছে। সকাল ৮টা থেকে বালাগঞ্জের বোয়ালজোড় ইউনিয়নের পাঁচটি কেন্দ্র আমি পরিদর্শন করেছি। কারণ আমাদের জানা ছিল, বোয়ালজোড়ের একজন ক্ষমতাসীন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাক প্রতীকে তিন ভোট পাবেন। আমি ভাবলাম যেহেতু তিনি এ ধরনের বলেছেন, তাহলে তার ইউনিয়নে যাই। বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করি। কিন্তু বোয়ালজোড় কেন্দ্রে যাওয়ার পর বিকেল তিনটা পর্যন্ত ওই পাঁচটি কেন্দ্রেই ঘুরতে হয়েছে। আমি একটি কেন্দ্রে যাই, তখন অন্য কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতির খবর পাই। এভাবে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে ঘুরতে থাকি।
তিনি বলেন, সাড়ে ১২টার দিকে বোয়ালজোড় প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বালাগঞ্জ থানা নির্বাচন কমিটির সমন্বয়ক থানা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি সম্পাদককে মাথা ফাটিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। গিয়ে দেখতে পাই আহতাবস্থায় তাকে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়, আমি না গেলে কেউ উদ্ধার করবেন না। গিয়ে দেখি আমার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট একটি কক্ষে আটক। আর প্রিসাইডিং অফিসার কক্ষে আরামে বসে আছেন। নীরবে সময় কাটাচ্ছেন। এতেই বোঝা যায় তিনি নির্বিকার ছিলেন এবং হামলাকারীর পরস্পর যোগসাজসে আমার নির্বাচনী প্রধান এজেন্টকে রক্তাক্ত করা হয়।
ওখানে গিয়ে শুনতে পেলাম কেন্দ্রের বিপরীতে একটি বাড়িতে অস্ত্র রাখা। আমার নির্বাচনী এজেন্ট যখনই জাল ভোটের প্রতিবাদ করেন, তখন তাকে চলে যেতে বার বার হুমকি দেওয়া হয়। তিনি চলে না যাওয়াতে তার ওপর আক্রমণ হয়, বলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী দুলাল।
তিনি বলেন, এই আক্রমণ সামাল দিতে না দিতেই বোয়াল জোড়ের আরেকটি কেন্দ্রের সামনে থেকে ফোনকল আসে, স্যার আমাদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তারা পাঁচজন এজেন্ট ছিল। ওখানে দৌড়ে গেলাম এবং জানলাম, তারা জাল ভোটে আপত্তি দিতেই আমার এক এজেন্টকে বলা হলো, যদি বাধা দাও ‘তোমার ছেলেকে মেরে ফেলবো, হাড় গুড়া করে ফেলবো। ’ ওখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও স্ট্রাইকিং ফোর্সকে পেলাম। অথচ সকাল ৮টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বোয়ালজোড়ের কেন্দ্রগুলোতে ছিলাম, কোথাও কোনো স্ট্রাইকিং ফোর্স, কোনো পুলিশ, কোনো বাহিনীকে পায়নি।
ডা. দুলাল বলেন, যেখানেই যাচ্ছি, বিয়ষগুলো সহকারী রিটার্নিং অফিসার ইউএনওকে জানাচ্ছি। আপনারা জেনে অবাক হবেন, তিনি ফোনকল না ধরে সহকারীকে দিয়ে ফোন ধরান। সহকারী আমাকে পরামর্শ দেয় সরি মিটিংয়ে একটা-দেড়টার দিকে ফোন করার জন্য। সহকারী আমাকে বলে একটার আগে ফোন দেওয়া যাবে না। বললাম, গিয়ে বলেন আমি প্রার্থী বলছি, কথা বলার জন্য, তারপর তিনি ফোন দিলেন, আমাকে বললেন দেখছি। সাড়ে ১২টায় এজেন্ট রক্তাক্ত হলেন, তাকে ফোনকল করলাম, তিনি বললেন, দেখছি। তখনো পুলিশ আসেনি। তারপর থানার ওসিকে ফোন দিলাম, তিনি বললেন, পেট্রল টিম পাঠাচ্ছি। সেই টিম এলো পৌনে ১টার দিকে। এজেন্টকে উদ্ধার করলো। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সেখানে এজেন্টরা থাকতে রাজি হননি। পুলিশকে বলার পরও কেন্দ্রের বিপরীতে যে বাসায় অস্ত্র রাখা ছিল, সেখানে অভিযান চালায়নি পুলিশ। আমরা ওই বাড়ির ছেলেটির নামও দিয়েছিলাম।
তখন তিনি নির্বাচন স্থগিত করার জন্য অ্যাসিল্যান্ডকে বলেন, তার মতে, প্রিসাইডিং অফিসার একজন নির্লিপ্ত টাইপের লোক। আমার জানা মতে তিনি একজন প্রার্থীর পক্ষে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম, আপনি যে চাকরি করেন, আমিও অনেক আগে সেই চাকরি শেষ করে আসছি। আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী, আপনি প্রার্থী হিসেবে আমার সঙ্গে অন্তত ভালো ব্যবহার করুন। আমার অধিকার আছে, কেন্দ্রে প্রবেশের। আপনি সহযোগিতা করবেন, তিনি (প্রিসাইডিং অফিসার) কোনো কথা বলেননি, উনি নির্বিকার একজন অথর্ব কর্মকর্তা।
ডা. দুলাল বলেন, একটার পর থেকে ননস্টপ ফোনকল আসা শুরু করে আমার মোবাইলফোনে। দক্ষিণ সুরমা-বালাগঞ্জসহ বিভিন্ন কেন্দ্র এজেন্টদের হুমকি দিয়ে বের করে দেয় নৌকার পক্ষের লোকজন এবং বহিরাগতরা। আর নারী এজেন্টদেরতো হুমকি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা জানি ভোটকেন্দ্রে কেউ মোবাইলফোন নিয়ে প্রবেশ করবেন না। কিন্তু আমি যতটা কেন্দ্রে গেছি নৌকার এজেন্টদের কাছে মোবাইলফোন পেয়েছি। আপনারা আরও শুনে অবাক হবেন, ইসির সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, কোনো যানবাহনে পোস্টার থাকবে না। কিন্তু যতটি যানবাহন লোক নিয়ে এসেছে বা চলাচল করছে নৌকার প্রার্থীর পোস্টার সাঁটানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নির্বাচন কমিশন অন্ধ হয়ে গেছে, তারা এগুলো দেখলো না।
তিনি এ বিষয়ে অভিযোগ করলে ওসি বলেন, আমি নির্বাচন কমিশনের অধীনে, আপনি কমিশনে ফোন করেন। সহকারী রিটার্নিং অফিসার বললেন, আমি মিটিংয়ে আছি। আরেক সহকারী রিটার্নিং অফিসার বলেন, আমি দেখছি ‘বাধ্য হয়ে আমি রিটার্নিং অফিসারকে ফোন করি। তিনি দেখছি বলেন, কিন্তু কি দেখলেন, আর জানি না। দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে অন্তত ৪০ কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। সেসব কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রিসাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে জাল ভোটের মহোৎসব চলেছে। এহেন পরিস্থিতিতে ভোট বর্জন করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এসব অভিযোগ প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২৪
এনইউ/এএটি