ঢাকা: দেশসেরা প্রযুক্তিবিদরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পরীক্ষা করে দেখে বলেছেন—এটি ‘পারফেক্ট’ ও নির্ভযোগ্য মেশিন। আপনারা এই কমিশনকে বাদ দিয়ে নতুন কমিশন গঠন করলেও ইভিএম ব্যবহার করুন।
বুধবার (২৫ মে) নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ডাকে সাড়া দিয়ে বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষকরা এসে যন্ত্রটি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা দেন। এমনকি এর গঠন পদ্ধতি, বিভিন্ন সার্কিট তারা খুলে দেখেন।
সকাল সোয়া ১০ থেকে অনুষ্ঠিত প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, চার নির্বাচন কমিশনার এবং শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কায়কোবাদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মতিন সাদ আবদুল্লাহ, ড. মো. মাহফুজুল ইসলাম, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) পরিচালক মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের পর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, গতবার যখন (সংলাপে) এসেছিলাম, একজন বলেছিলেন—ইভিএম হাইটেক মেশিন। আমি বলেছিলাম, মোটেই হাইটেক নয়। এটা আমাদের ছাত্ররা বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পুরস্কারও পেয়েছে। তাই মেশিনটা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে উপস্থাপনের জন্য বলেছিলাম। ইসি সেই অনুরোধটি রেখেছে। সেজন্য তাদের ধন্যবাদ।
তিনি বলেন, আমরা বৈঠকে ডেমোনেস্ট্রেশন দেখেছি পুরোটা। ভেতরের খুঁটিনাটিও জেনে নিয়েছি ওনারদের কাছ থেকে। আর একটা মেশিন ওনারা আমাদের জন্য খুলে রেখেছেন, যাতে আইসি লেবেল পর্যন্ত দেখতে পারি। এগুলো কীভাবে মাউন্ট করা হয়েছে। কেউ যদি এগুলো ম্যানিপুলেট করতে চায়, সেটা কতটা কঠিন হবে, সোজা হবে সে ধারণা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে কনভিন্সড হয়েছি যে, অত্যন্ত চমৎকার একটি মেশিন। মানুষজন সব সময় উদাহরণ দেয়, পৃথিবীর অমুক দেশ পারে নাই, অমুক দেশ পারে নাই, আমরা কেন করতে যাচ্ছি? আমি মোটেই সেভাবে দেখি না। আমি মনে করি আমাদের বাংলাদেশ, এই সমস্ত ব্যাপারে অনেক এগিয়ে আছে। ইনফ্যাক্ট আমাদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ যেটা আছে, যেটাকে এনআইডি বলে থাকেন, আমার মনে হয় পৃথিবীর খুব কম দেশেই এই মূল্যবান জিনিসটা আছে। এটা থাকার জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি, যেটা অনেক দেশ করতে পারে না। নিজের দেশের ওপর কনফিডেন্সটা রাখতে হবে। যেহেতু আমাদের বায়োমেট্রিক ডাটা আছে।
তিনি বলেন, এখানে ভোটিংটা অনেক নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। একজন মানুষ অন্য মানুষের ভোট দেওয়ার বিষয়টা মোটামুটিভাবে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই যারা এটা তৈরি করেছেন, আমি তাদের অভিনন্দন এবং আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।
ড. জাফর ইকবাল আরও বলেন, মেশিনটা (ইভিএম) মোটামুটি পারফেক্ট একটা মেশিন। আমাদের দেশের জন্য এটা অত্যন্ত সহজভাবে চালানো সম্ভব। খবরের কাগজে দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো নতুন কমিশন তৈরিসহ তিনটা দাবির কথা জানিয়েছে। আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে বলবো, আপনারা যদি নতুন কমিশন তৈরি করতে পারেন, তখনো এই ইভিএম মেশিনটা ব্যবহার করবেন। আপনাদেরই লাভ হবে।
সাংবাদিদের এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, পৃথিবীতে ধরেন যখন স্পেসশিপ পাঠানো হয়েছিল, ট্রিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট, সেটাও ভেঙে পড়েছিল। কাজেই কোনো যন্ত্র যদি হয়, সেখানে আপনি কখনোই বলবেন না, বলা উচিত না, শতভাগ সফল হবে। কিন্তু আমরা বলতে পারি, যে এটা প্রসেসে যদি সমস্যা হয়, ঠিক করার ব্যবস্থা আছে কিনা। আমাকে যদি বলা হয়, একটা যন্ত্র তৈরি করে দাও, যন্ত্র যদি ম্যালফাংশন করে, সেটা ঠিক করার ব্যবস্থা করে দাও, তাহলে আমি রাজি আছি। এখানেও তাই আছে। বিভিন্ন ধরনের ডেটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।
তিনি আরও বলেন, ম্যানুপুলেশন করার এখানে কোনো জায়গা নেই। ম্যানুপুলেশন করার জন্য যে লেভেলে যাওয়ার দরকার, সেই লেভেলে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। অপারেট করার শুরুতে এটা দেখানোর ব্যবস্থা আছে, যেখানে কী আছে, না আছে। এখন বিশ্বাস করবেন কি করবেন না, সেটা আপনাদের বিষয়।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, এক মার্কার ভোট এক প্রার্থীর মার্কায় গিয়ে পড়বে, এটা এই মেশিন দ্বারা করা সম্ভব না। আমি সার্কিটগুলো খুলে দেখানোর জন্য বলেছিলাম। এটা ম্যালফাংশন করতেই পারে, ম্যালফাংশন করলে সেটা পরবর্তীতে অন্য মেশিন ব্যবহার করা যায়, কিন্তু ম্যানপুলেট করার কোনো সুযোগ নেই।
সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভোট দেওয়ার পর পেপার কেটে কেটে রাখার আইডিয়াটা আদিম আইডিয়া। এটা মেশিনেই থাকে, এটা নতুন করে করার দরকার নাই। এটা আরেকটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি করবে। কারণ রাতের বেলা পেপার কেটে কেটে অনেকে ভেতর রাখতে পারেন, এতে আরও বিড়ম্বনা হবে। ভারত করেছে তাই আমাদের করতে হবে, এই ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি সেটা বিশ্বাস করি, আমার দেশের প্রযুক্তিবিদ যারা আছেন, তারা অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
আঙুলের ছাপ না মিললে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার আঙযলের ছাপ ব্যবহার করার বিষয়ে জাফর ইকবাল বলেন, পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই বা মেলে না। হাত কাটা পড়েছে, সেই ধরনের মানুষের জন্য একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর বেশি কিছু না। আমি যেহেতু টেকনোলজির মানুষ আমি বলবো, এই জিনিসটা (ইভিএম) অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।
অধ্যাপক এম কায়কোবাদ বলেন, কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে (ইভিএম), ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই। প্রত্যেকটা বিষয় এমনভাবে কাস্টমাইজ করা হয়েছে, কেউ ইচ্ছা করলেই সেটা ম্যানিপুলেট করা সম্ভব না।
তিনি বলেন, আমরা একটি স্মার্ট দেশ। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যথেষ্ট দক্ষ। তাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারি। এই প্রকল্পে যারা ছিলেন, তাদের যে কমিটমেন্ট তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, এটা খুব ভালো মেশিন তৈরি করা হয়েছে। আমি আশা করি, এটার ডিসপ্লে করা হবে, সেটা টেস্ট করতে পারবে যে কোনো নাগরিক। তারা এসে দেখতে পারবে যে, এখানে সবকিছু ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে ড. কায়কোবাদ বলেন, তাদের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টা নির্বাচন কমিশনের আইনে রয়েছে এবং সেটা তারা করবে। বায়োমেট্রিক সার্চ করে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করি। যে কোনো মেশিনের জন্য আধুনিকায়ন জরুরি এটার প্রতিটা ছোট ছোট অংশ যেভাবে কাস্টমাইজ করা হয়েছে, কেউ এসে এটাকে ম্যানিপুলেট করবে, এটা সম্ভব নয়। আমরা পরামর্শ দিয়েছি, এই মেশিন থেকে শুধু ভোট দেওয়ায় নয়, ভোটের যত স্ট্যাটিস্টিকস আছে, সব ধরণের ব্যবস্থা রাখতে। আশা করি এগুলি ওনারা পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে করবেন।
আরও পড়ুন: দলগুলোকে ইভিএম যাচাইয়ের আহ্বান জানাবে ইসি
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২২/আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা
ইইউডি/এমজেএফ