ঢাকা: প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, আমরা চেয়েছিলাম ঋণ খেলাপের নামে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যে অধিকার, তা যেন কারো ক্ষেত্রে খর্ব না হয়। তবে ব্যাংকগুলো আগের অবস্থানেই রয়েছে।
ঋণ খেলাপের বিষয়টি স্পষ্টিকরণের জন্য নির্বাচন ভবনে সোমবার (০৬ জুন) আয়োজিত এক মতবিনিময়র সভা শেষ তিনি এ কথা জানিয়েছেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ব্যাংক ও পরিষেবা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০০৮ সালে বিধান করা হয়েছিল যারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হবেন, তারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। আমাদের অভিমত অনুযায়ী, যাদের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান মামলা করবে, তারাই খেলাপি হবেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী, যারা সত্যিকারের খেলাপি নন, তারাও অযোগ্য হয়ে পড়তে পারেন। ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার, মৌলিক অধিকার। যেনতেনভাবে যেন অধিকারটা খর্ব না হয়, আমরা সেটা চেয়েছিলাম এবং সেভাবে একটি খসড়াও করেছিলাম।
তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে যারা এসেছেন, তারা সবাই কনফোর্টেবল ফিল করছেন, আগের যে আইনটা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) থেকে লিস্টটা দেওয়া হয়, তার ভিত্তিতেই যেন ঋণ খেলাপি নির্ধারিত হয়।
সিইসি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ নিয়ে আমরা বলেছিলাম, কেউ যদি এসব বিল না দেয়, আমাদের কাছে এগুলো বাহুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কেউ যদি গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন বিল না দেয়, তার লাইন সহজেই কেটে দেওয়া যায়। তারপরও আমরা প্রস্তাব করতে চাচ্ছিলাম ইভেন পরিষেবা বিল খেলাপি, তাদের বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা হয়, তাদের আমরা বিল খেলাপি বলতে চাই। কারণ আড়াশই টাকার একটা টেলিফোন বিল বাকি আছে, সে হয়তো জানেও না। হয়তো অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। টেলিফোনে… ওরাও কিন্তু খেলাপি মনে করে না। লাইন কেটে দেয়। বিল দিয়ে দিলে আবার পুনঃসংযোগ দেয়।
তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি টাকা লুট করার জন্য ঋণ পরিশোধ না করেন। আমি আইনের ছাত্র হিসেবে জানি, লোনটা কিন্তু একটা সিভিল অ্যাগ্রিমেন্ট। কোনো কারণে কেউ ব্যর্থ হতে পারে। এটা কিন্তু জেনেই ব্যাংক ঋণ দেয়। মহামারি হতে পারে, যুদ্ধ হতে পারে, মৃত্যু হতে পারে। অনেক সময় যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়, সেই ঋণটা যিনি নেন, তিনি ব্যবহার করতে পারেন না। সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না, ঋণটাও পরিশোধ করতে পারেন না। দ্যাট ইজ নট এ ক্রিমিনাল বরোয়ার। এই জিনিসটা স্পষ্ট করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাংক থেকে যারা এসেছেন, তারা কিন্তু ব্যাংকিং দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখছেন যে, এনি ডিফল্টার ইজ এ সিরিয়াস ডিফল্টার। কিন্তু আমরা দেখতে চেয়েছিলাম একটু ভিন্নভাবে।
সাবেক এই সিনিয়র সচিব বলেন, ২০০৮ সালের আগে এই আইন ছিল না। ২০০৮ সালের আগে এই আইন না থাকার কারণে ব্যাংকগুলো ডুবে গিয়েছিল, লাখ লাখ টাকা খেলাপি ছিল, আর এই আইন হওয়ার পরে ঋণ খেলাপি হয় না, তা সত্য। আসলে ব্যাংকের ঋণ কীভাবে আদায় হবে, সেটা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ যে মেকানিজম, তাদের নির্ধারণ করতে হবে। যেমন আমরা বলেছিলাম, যে কোনো একটা কোম্পানির সাতশ কোটি টাকার গ্যাস বিল বাকি। সাতশ কোটি টাকা তো একদিনে হয় না। সেখানে ডিপার্টমেন্টেরও দায়িত্ব ছিল একটা পর্যায়ে গিয়ে লাইনটা বন্ধ করে দেওয়া। কেটে দেওয়া এবং গ্যাস সরবরাহ না করা। কিন্তু আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তারা কিন্তু শক্তিশালী। ঋণ নিয়ে খেলাপ করতেই পারবে। গ্যাস নিয়ে বিল খেলাপ করতে পারবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। তো এজন্য আমরা বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছি। অধিকাংশ ব্যাংকারা বলেছেন, এখন যে বিধানটা রয়েছে সেটা থাকলেই ভালো হয়। আমরা বিষয়টা শুনেছি। যেটা প্রস্তাব করেছিলাম, তারা বিষয়টি কমফোর্টেবল ফিল করেন না। আমরা সেই আলোচনা নিয়ে চিন্তা করবো। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবো এই সংশোধনে যাব কি যাব না।
সিইসির সভাপতিত্বে বেলা ১১টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিবসহ সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ড্রাফটিং) হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ডিন ড. সীমা জামান, ডেসকো'র চিফ ইঞ্জিনিয়ার রশিদুর রহমান, ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজিজুল হক পান্না, আইন ও বিচার বিভাগের উপ সচিব প্রশাসন (জেলা জজ) শেখ গোলাম মাহবুব, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (বিআরপিডি) মাকসুদা বেগম, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড'র জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল কদ্দুস, বিটিসিএল'র জেনারেল ম্যানেজার (ফিন্যান্স অ্যান্ড বাজেট) মাজহারুল ইসলাম, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড'র জেনারেল ম্যানেজার দেওয়ান রুহুল আহসান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক'র স্পেশাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (ডিভিশনাল হেড) মীর ইকবাল হোসেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক'র কান্ট্রি হেড নুর হোসাইন আল কাদেরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (বাজেট) ফারুকুজ্জামান, তিতাস গ্যাস লিমিটেড'র পরিচালক (অর্থ) অর্পণা ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান।
বর্তমান আইন অনুযায়ী, বড় ঋণগ্রহীতারা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি বা পুরো ঋণ পরিশোধের সময় পান। এছাড়া আর ছোট ঋণ গ্রহীতারা বা খেলাপিদের মনোনয়নপত্র দাখিলের অন্তত সাতদিন আগে দেনা পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বড় ও ঋণ গ্রহীতার মধ্যে সমতা নেই। কমিশন এখানে সমতা আনতে চান। এছাড়া কমিশন মনে করে কেউ কয়েকটি কিস্তি দিতে না বা পরিষেবার বিল সঠিক সময়ে দিতে না পারলে বা বিলম্ব হলেই খেলাপি হয়ে যায় না। এজন্য আদালতের নির্দেশনা বা অন্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে কেউ সময় মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে বা বিল দিতে না পারলে নির্বাচনের আগে খেলাপি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য দেওয়াটা প্রার্থীর প্রতি অবিচার। তাই এটি পরিবর্ত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০২ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০২২
ইইউডি/আরআইএস