ভারতের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বলিউডের সিনেমা একই দিনে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা থাকলেও বাংলাদেশে এমনটা ঘটেনি। তবে এবার শাহরুখ খান অভিনীত ‘জওয়ান’ সেই ঘটনার প্রথম ছবি হতে যাচ্ছে।
জানা গেল, আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সেন্সরবোর্ড থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়েছে সিনেমাটি। প্রথম হিন্দি ছবি হিসেবে ভারতের সঙ্গে একই দিনে বাংলাদেশেও মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘জওয়ান’।
আজ সন্ধ্যা থেকেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাটির প্রদর্শনী শুরু হবে বলে নিশ্চিত করেছেন সিনেমাটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্টের অনন্য মামুন।
বিষয়টিতে রীতিমতো উন্মত্ত বাংলাদেশের শাহরুখভক্তরা। এই প্রথম ভারতসহ সারাবিশ্বের শাহরুখভক্তদের সঙ্গে ‘জওয়ান’ জ্বরে কাঁপবেন তারাও। সিনেমা মুক্তির খবর শোনার আগেই নিজ উদ্যোগে শহরে প্রচারণা চালিয়েছেন কেউ কেউ, হলে গিয়ে শাহরুখের পোস্টার সেঁটেছেন অনেকে।
ঢাকায় একটি মাল্টিপ্লেক্সের গোটা একটি শোয়ের টিকিট কেনার খবরও শোনা গেছে।
জওয়ানের আগমন নিয়ে যখন বাংলাদেশে শাহরুখভক্তরা উন্মাদনায় মাতোয়ারা, তখন পাল্টা প্রতিক্রিয়ারও দেখা মিলেছে।
ভারতের সঙ্গে দেশে একই দিনে ‘জওয়ান’ মুক্তি দেওয়াটা ঢাকাই চলচ্চিত্রের জন্য কতটুকু ক্ষতি? এতে হল মালিক ও আমদানিকারকরা ছাড়া আর কারা লাভবান হবেন? দেশের সিনেমার স্বার্থ কতটা থাকছে?
এসব প্রশ্ন উঠেছে পরিচালক, প্রযোজক ও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ, ‘জওয়ান’ মুক্তির সময়ই মুক্তি পেতে যাচ্ছে দেলওয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘সুজন মাঝি’।
‘জওয়ান’-এর ঝড়ে ‘সুজন মাঝি’ উড়ে যায় কি না সেই শঙ্কা জেগেছে।
এটা সত্য যে, ঢাকার সিনেপ্লেক্স, মাল্টিপ্লেক্সগুলো আর ‘সুজন মাঝি’ চালাবে না। ঢাকার বাইরেও অনেক বড় বড় প্রেক্ষাগৃহে চলবে না সিনেমাটি।
যেমন একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল যশোরের মনিহারে শাহরুখের ‘জওয়ান’ দেখানো হবে।
জানা গেছে, আগামীকাল শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) দেশের ১৯টি সিনেমাহলে মুক্তি পাচ্ছে ‘সুজন মাঝি’। একই সময়ে চলতে থাকা ‘জওয়ান’ না দেখে সিনেপ্রেমীরা ‘সুজন মাঝি’তে বুঁদ হবেন? সে শঙ্কা থেকেই যায়।
আর হলে দর্শক না গেলে সিনেমা ফ্লপ। পরিচালকের ক্যারিয়ার শেষ।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ খোদ দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। বাংলাদেশে ‘জওয়ান’ মুক্তি ঠেকাতে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন এ গুণী নির্মাতা।
অবশ্য বরাবরই হিন্দি সিনেমা আমদানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। দেশের সিনেমা হলে ‘পাঠান’ ও ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’ মুক্তির আগে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন তিনি। তবে এত প্রতিক্রিয়া দেখাননি, যতোটা ‘জওয়ান’-এর বেলায় দেখা গেছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে এফডিসিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ঝন্টু প্রশ্ন তোলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বারণ করেছেন হিন্দি সিনেমাকে। সেটা কীভাবে মুক্তি পাচ্ছে? যদি কোনোভাবে মন্ত্রণালয় এটা (জওয়ান) মুক্তি দেয়, তাহলে আমরা পথে নামব, আন্দোলন করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না। ’
এ নির্মাতা আরও বলেন, ‘আমরা চাই না এ দেশে বিজাতীয় ভাষার কোনো ছবি রিলিজ হোক। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংলিশ সাবজেক্ট আমাদের পড়ানো হয়, ইংলিশ ছবি আসলে আপত্তি নেই। সেটা ঠিকাছে। কিন্তু হিন্দি ছবি ‘জওয়ান’ আসলে আমরা আপত্তি করব। আন্দোলন করব, আন্দোলন করব, আন্দোলন করব! কেউ যদি না যায়, তাহলে আমি একা সিনেমা হলের সামনে গিয়ে মশাল নিয়ে দাঁড়াব। ’
এক্ষেত্রে ঝন্টুর পাশে পাওয়া গেল আরেক চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমানকে। তিনিও দেশে সিনেমার স্বার্থের কথা মনে করিয়ে দিলেন।
জানালেন, একই দিনে মুক্তির কারণে দেলওয়ার জাহান ঝন্টু না সরলেও ‘অন্তর্জাল’সরে গেছে। সিনেমার পরিচালক-প্রযোজক রিস্ক নেবেন না।
এতে কি বাংলাদেশের সিনেমার স্বার্থ রক্ষা হলো নাকি ব্যবসায়ীদের? - সে প্রশ্ন রাখলেন তিনিও।
তার ব্যাখ্যা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হলগুলো বাঁচিয়ে রাখতে ভারতীয় সিনেমা আমদানির বক্তব্য ভিত্তিহীন। কারণ, খুব বেশি সিঙ্গেল হলে মুক্তি পাবে না ‘জওয়ান’। সেই সুযোগও কম। কারণ, ওই সব হলে ভালো পরিবেশ নেই, পর্দা ভালো নেই। ‘জওয়ান’–এর অরিজিনাল সাউন্ড পাওয়া যাবে না সেসব প্রেক্ষাগৃহে। দর্শকরা এ ধরনের সিনেমা দেখতে সিনেপ্লেক্সগুলোকেই বেছে নেবে।
তবে পরিচালক, বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া থোড়াই কেয়ার করছেন দেশের সিনেপ্রেমীদের বড় একটি অংশ।
তারা চাচ্ছেন ‘পাঠান’ সিনেমার মতো না ঘটুক ‘জওয়ান’ এর বেলায়। তিন মাস পর দেশের হলে মুক্তি পেলে সেই সিনেমার ক্রেইজ আর থাকে না। তার আগেই বিভিন্ন মাধ্যমে সিনেমাটি দেখা হয়ে যায়। দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটিয়ে ফেলা হয়। তাছাড়া নেটামাধ্যমের কল্যাণে সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য, গান, অ্যাকশন চলে আসে সামনে। গল্প জানা হয়ে যায়। এ নিয়ে রিভিউ পড়ে পড়েই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেকে।
জওয়ানের বেলায় এমনটি না হোক চাচ্ছে শাহরুখ খানের বাংলাদেশি ফ্যানক্লাব ‘ট্রু এসআরকিয়ান্স বিডি’।
ফ্যানক্লাবটির এডমিন মেহেদী হাসান জানান, রাজধানীর একটি প্রেক্ষাগৃহ তারা ভাড়া করেছেন। সেখানেই মুক্তির প্রথম দিন ‘জাওয়ান’র প্রথম শো দেখাবেন। সিনেমা দেখানোর পাশাপাশি টি-শার্ট, কেক কাটা, ব্যানারসহ নানা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষার্থী জানালেন, তারা শাহরুখের ভক্ত। যে কোনো মূল্যে মুক্তির প্রথম দিনেই সিনেমাটি দেখতে চান তারা। টিকিটের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
‘জওয়ান’ -এর অপেক্ষায় যে অনেকেই রয়েছেন তার বোঝা গেলে সিনেপ্লেক্সে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের কণ্ঠে।
রাজধানীর একটি সিনেপ্লেক্সের দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন, প্রতিদিন টিকিট কাটতে অনেক দর্শক আসছেন। যদিও টিকিট দেওয়া শুরুই হয়নি। কিন্তু প্রতিদিনই ভিড় জমছে কেবল জওয়ান দেখার আশায়। তারা অগ্রিম বুকিং দিতে আসছেন।
শাহরুখের ‘জওয়ান’ মুক্তির বহু আগে থেকেই ছিল আলোচনায়। সিনেমাটির বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ ওঠে। মানিকম নারায়ণন নামে একজন তামিল প্রযোজক এই অভিযোগ তোলেন। তার অভিযোগ ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া তামিল সিনেমা পেরারাসু-এর গল্প কপি করা হয়েছে।
পেরারাসুর গল্প একজন সৎ সিবিআই কর্মকর্তাকে নিয়ে। যাকে একজন বিচারকের নিখোঁজ হওয়ার তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি যখন অপরাধীদের কাছাকাছি পৌঁছান তখন অজ্ঞাত ব্যক্তির দ্বার একের পর এক খুন হন অপরাধীরা। পরে প্রকাশ পায় অজ্ঞাত ব্যক্তিটি সেই সিবিআই কর্মকর্তার যমজ।
অন্যদিকে জওয়ানের প্লটও কাছাকাছি ধরনের। পেরারাসু’ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিজকান্ত। এদিকে ‘জওয়ান’ ছবিতেও দ্বৈত চরিত্রে দেখা যাবে শাহরুখকে।
‘জওয়ান’-এর মূল কাহিনি দু’টি আলাদা সময়ের প্রেক্ষাপটকে ঘিরে। বিক্রম রাঠৌর এবং আজাদের জীবনের কাহিনি। তাদের পাওয়া-না পাওয়ার, হারজিতের গল্পকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলে ‘জওয়ান’।
উল্লেখ্য, ‘জওয়ান’ বাংলাদেশে এসেছে মুম্বাইয়ে পরিবেশক প্রতিষ্ঠান সিনেকন এন্টারটেইনমেন্টের কাছ থেকে। এটি আমদানির বিপরীতে ভারতের এসএসআর এন্টারটেইনমেন্টের কাছে বাংলাদেশ থেকে ‘নবাব এলএলবি’ ছবিটি রপ্তানি করা হয়েছে।
সিনেমাটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট।
অ্যাটলি কুমার পরিচালিত ‘জওয়ান’ সিনেমাটিতে শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় করেছেন দক্ষিণী তারকা নয়নতারা। এ ছাড়া ছবিতে আছেন বিজয় সেতুপতি, সানিয়া মালহোত্রা, প্রিয়ামনি প্রমুখ। ছবিটি হিন্দি, তামিল ও তেলেগু ভাষায় মুক্তি পেয়েছে।
ভারতীয় বিভিন্ন পোর্টালের রিপোর্ট অনুযায়ী, শাহরুখের ক্যারিয়ারের সব থেকে বিগ বাজেট ছবি ‘জওয়ান’! সিনেমাটির বাজেট ৩০০ কোটি রুপি। ভক্তরা যাতে সিনেমা হলে গিয়ে সেরা অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, সেরা গল্প এবং ভিজ্যুয়ালে সাক্ষী থাকতে পারে, সে জন্য মোটেই কার্পণ্য করেননি শাহরুখ খান।
‘পাঠান’ এর বাজেট ছিল ২৫০ কোটি, এর আগে শাহরুখের ‘জিরো’র বাজেট ছিল ২০০ কোটি। দিলওয়ালে এবং রাওয়ান বানাতে যথাক্রমে খরচ হয় ১৩৫ কোটি এবং ১৩০ কোটি। রইজের বাজেট ছিল ৯৫ কোটি, আর হ্যাপি নিউ ইয়ারের বাজেট ১৫০ কোটি ছিল। এবার সেসব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে জওয়ান।
বিশ্লেষকদের খবর, পাঠানের রেকর্ড ভেঙে ফেলবে ‘জওয়ান’। প্রথম দিনের কাটা টিকিট হিসেবে এই সিনেমা মোট ৪০ কোটি রুপি আয়ের গণ্ডি পেরিয়ে গেছে। চার দিন ব্যাপী লম্বা ‘উইকেন্ড’-এর টিকিট বিক্রি হয়েছে ইতোমধ্যেই প্রায় ৭০ কোটি রুপি।
সেই হিসেবে ‘জওয়ান’ শুধু প্রথম দিনের নিরিখে বিশ্বব্যাপী বলিউড ফিল্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয় করছে তাই নয়, এটি বলিউড ফিল্মের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় চার দিনের সপ্তাহান্তের আয়ের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৩
এসএএইচ