বিপিএলের প্রতিদিনের খেলা শুরুর আগে, মধ্যবিরতি এবং শেষে টিভির পর্দায় দর্শকরা ‘পাওয়ার প্লে’ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক হিসেবে পেয়েছেন কলকাতার মেয়ে শিনা চৌহানকে। শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) ফাইনালেও ব্যতিক্রম হবে না।
গত ৩ নভেম্বর থেকে ঢাকায় আছেন শিনা। বিপিএল দিয়ে তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত মুখ। এ অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সুবাদেই অভিনয় করেছেন ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ ছবিতে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে গত ৬ ডিসেম্বর চিটাগং ভাইকিংস বনাম রাজশাহী কিংসের খেলা চলাকালীন বাংলানিউজের সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলেন ভারতের এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় এই মডেল-অভিনেত্রী।
বাংলানিউজ: বিপিএলের সুবাদে তো ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন!
শিনা: আরে না! আমি ক্রিকেট ভালোবাসি। আপনারা জানেন বিপিএলের প্রথম আসর থেকে এখানে আসছি। দিনে দিনে অনেক শিখেছি। ক্রিকেটের খুঁটিনাটি জেনেছি। আর বিপিএলের মাধ্যমে বালাদেশের মানুষের সঙ্গে আমার যে বন্ধন, সেটাকে লালন করি। এই বন্ধনটা আমার জন্য অনেক স্পেশাল। বাংলাদেশ আমার সেকেন্ড হোম। এখানে অতিথিদেরকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। আমার তো মনে হয় অভ্যর্থনা জানানোর বেলায় বাংলাদেশ সারাবিশ্বেই এক নম্বর।
বাংলানিউজ: বিপিএল উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা অন্যান্যবারের তুলনায় আলাদা মনে হয়েছে কোন দিক দিয়ে?
শিনা: বাংলাদেশে আসাটা বরাবরই আমার জন্য তুলনাহীন। এবার এসে আরও বেশি ভালোবাসা পেয়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে যেন সবাই ভালোবাসার সাগরে ভাসিয়েছেন আমাকে! এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। মাঠে কিংবা হোটেলে- সবখানেই অভাবনীয় সহযোগিতা পেয়েছি। আমার রূপসজ্জাকরসহ পুরো টিমের কাছ থেকে অনেক সহায়তা এসেছে। আমাকে নিজের দেশের মতোই দেখেন তারা।
বাংলানিউজ: হোটেল ছাড়া খাওয়ার সুযোগ হলো?
শিনা: রূপ বিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান আমার অনেক যত্ন নেন। আমার স্টাইল তিনিই করছেন এখানে। আমরা খুব ভালো বন্ধু। তিনি আমাকে রান্না করে খাইয়েছেন ডাল, মাংস, মাছ, মিষ্টি। হোটেলে খেতে খেতে একঘেঁয়েমি চলে আসে, তাই বাসার সাধারণ খাবারও খুব উপভোগ করেছি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আর তিশাও নেমন্তন্ন করেছেন তাদের বাসায়।
বাংলানিউজ: ফারুকীর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিলো?
শিনা: তার সঙ্গে বিপিএলে আমার শোতে প্রথম দেখা হয়েছিলো। এরপর তিনি আমাকে স্ক্রিপ্ট পাঠানোর জন্য ফোন করলেন কলকাতায়। সঙ্গে ‘টেলিভিশন’ ছবির ডিভিডিও দিলেন। এটা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। তিশার সাবলীল অভিনয় চমৎকার লেগেছে। এরপর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র চিত্রনাট্য দেখে মনে হলো রিমা চরিত্রটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। আর আমারও সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতেই ভালো লাগে। এ ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করতে চাই। তাই সুযোগটি হাতছাড়া করিনি। আমাকে প্রস্তুতিও নিতে হয়েছে। স্কাইপের মাধ্যমে ভাষাগত দিক দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছি।
এরপর ফারুকী আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। এর দৃশ্যধারণের অভিজ্ঞতা আমার জন্য স্পেশাল ছিলো। রিমার মতো চ্যালেঞ্জিং চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারা আমার জন্য বিশেষ অর্জন। আমি একজন আর্টিস্ট, আমি চাই আমার আর্টটা যথাযথভাবে বেরিয়ে আসুক। এটা ফারুকী দারুণভাবে বের করে আনতে পেরেছেন। ফারুকী-তিশার সঙ্গে এক-দুই মাস এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা দারুণ ছিলো। তিশা আমাকে পরিবারের মতো দেখেছেন। তার মায়ের বাসায়ও গিয়েছি।
বাংলানিউজ: ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ নিয়ে প্রতিক্রিয়া পেলেন কেমন?
শিনা: আপনারা জানেন, ছবিটি সাংহাই, কেরালা, দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসিত হয়েছে। এজন্য ধন্যবাদ জানাই ফারুকীকে। সবচেয়ে বড় কথা, আমি কাজটা করতে পেরেছি।
বাংলানিউজ: ঢাকার ছবিতে আপনাকে দর্শকরা আবার কবে দেখবে?
শিনা: সব ব্যাটে-বলে মিলে বাংলাদেশে আমার আবার কাজ করা হবে নিশ্চয়ই। এজন্য দরকার ভালো গল্প ও চরিত্র। আমার মনে হয়, শিল্প-সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ। এখানে খুব ভালো ভালো ছবি হচ্ছে। এখানকার প্রতিভাবান নির্মাতাদের কাজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। ফারুকী ছাড়াও অমিতাভ রেজা, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, আবু শাহেদ ইমনের নাম বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা জানেন।
বাংলানিউজ: ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ কী কী পরিবর্তন এনেছে আপনার ক্যারিয়ারে?
শিনা: এ ছবিতে কাজের সুবাদে বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে আমার বন্ধনটা আরও শক্ত হয়েছে। বলতে পারেন ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র সুবাদে দুটি বাংলা ছবিতে ডাক পেয়েছি। একটির নাম ‘জাস্টিস’। এর কাজ হয়েছিলো শিলংয়ে। এ ছবির পরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে মারা গেছেন। এটা খুব বেদনাদায়ক। তার ছবিতে আমাকে এমন একটি মেয়ের চরিত্রে দেখা যাবে যে ট্রাভেলিংয়ের মাধ্যমে জীবনকে খুঁজছে।
‘কৃষ্ণগহ্বর’ নামে আরেকটা ছবিতে অভিনয় করেছি বিজ্ঞানীর ভূমিকায়। এখানে আমার সহশিল্পী কৌশিক গাঙ্গুলী ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এর কাহিনি খুব সুন্দর। আমরা অর্ধেক কাজ করেছি। বাকি চিত্রায়ন শুরু হবে শিগগিরই। এ ছবির পরিচালক অয়ন চ্যাটার্জি। তিনি নতুন হলেও দারুণ মুন্সিয়ানা দেখাচ্ছেন। দুটি ছবিই মুক্তি পাবে আগামী বছর।
বাংলানিউজ: উঠতি উপস্থাপিকাদের জন্য কোনো পরামর্শ দেবেন?
শিনা: সবার মধ্যেই একটা তুলনাহীন প্রতিভা থাকে। আমার মধ্যেও সহজাত ব্যাপার আছে। খেয়াল করলে দেখবেন, উপস্থাপনার সময় আমি মজা করি। আমি আসলে এমনই। নিজের বিশেষত্ব ও সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করলেই আলাদা হওয়া যায়। সেই সঙ্গে নিজেদের সামর্থ্যেরও উন্নতি ঘটাতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৃজনশীলতা। সহজভাবে নিজের সেরাটা দেওয়াই জরুরি।
বাংলানিউজ: আপনি পরোপকারে সময় দেন। জাতিসংঘের ‘ইয়ুথ ফর হিউম্যান রাইটস’ প্রকল্পের শুভেচ্ছাদূতের কাজটা কীভাবে করেন?
শিনা: আমি একজন অভিনেত্রী তথা পারফর্মার। উপস্থাপনাও করি। কাজের পাশাপাশি আমাদের উচিত সমাজের জন্য কিছু অবদান রাখা। তাই মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছি। নিজেদের অধিকার নিশ্চিত হওয়া সম্পর্কে মানুষকে জানাতে চাই। আমরা যদি আমাদের অধিকার সম্পর্কে জানি তাহলেই কিন্তু তা আদায় করতে উদ্বুদ্ধ হবো। তাই শিক্ষা, সমতাসহ অধিকারের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করি। যেমন মানবপাচার, শিশুশ্রম বন্ধ হওয়া অনেক জরুরি। এ ছাড়া শিক্ষা বিস্তার হলে সমাজের উন্নয়ন ঘটে। এরকম আমাদের মোট ৩০টি অধিকার রয়েছে, আমি চাই সবাই এগুলো জানুক। আশা করি, একটা ইতিবাচক ফল পাবো।
বাংলানিউজ: নারী-পুরুষের সমতার বেলায় বাংলাদেশকে কেমন দেখেছেন?
শিনা: এখানে এ ব্যাপারটা ইতিবাচকভাবে এগিয়েছে। চার-পাঁচ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলছি। এখানে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। পুরুষরাও নারীদের এগিয়ে চলাকে সম্মান দিচ্ছেন। মা না থাকলে আমরা আসতাম না। এ বিষয়টা মনে রেখে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখলে সমতা ধরে রাখা যায়। আমরা সমান ভাবলেই সমান।
বাংলানিউজ: আপনার বাবা কুলওয়ান্ত সিং চৌহান ছিলেন পাঞ্জাবের মানুষ। মা হ্যারি চৌহান কলকাতার। তাদের কথা বলুন।
শিনা: বাবার বেঁচে নেই। তাকে মনে পড়ে। আর আজকে আমি যা কিছু সবই মায়ের অবদান। তিনি আমাকে অনেক সহায়তা করেন। আমার বয়স যখন দুই বছর, তখন থেকেই মা আমাকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় বরাবরই উৎসাহ দিতেন। অমলাশঙ্করের কাছে ক্লাসিক্যাল নাচও শিখেছি। কারাটে, নাচ, ড্রইং শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন মা। আমার কাজ সব তিনি দেখভাল করেন।
বাংলানিউজ: ছোটবেলা থেকে বেহালা বাজান শুনেছি।
শিনা: স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার স্বপ্ন ছিলো একটা ইনস্ট্রুমেন্ট বাজানো শিখবো। সিমলায় বোর্ডিং স্কুলে ছিলাম। সেখানে ড্রাম, তবলা, বেহালার মধ্য থেকে একটি বেছে নিতে বলা হলো। আমার সবসময় বেহালার সঙ্গে একটা রোম্যান্স ছিলো। জানি না কেনো! এরপর বেহালা নিয়ে অনেক অনুশীলন করেছি। এখন বাজানো হয় না। তবে বেহালা সবসময় আমার প্যাশন হয়ে থাকবে। স্কুলে অর্কেস্ট্রায় ছিলাম। বেহালা বাজালেই অন্যরকম একটা শান্তি পেতাম। এটা জেনেই বুদ্ধদেবদা (বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত) আমাকে তার ছবিতে নিলেন।
বাংলানিউজ: বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বলুন।
শিনা: আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি কবিতা অবলম্বনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের হিন্দি ছবি ‘মুক্তি’ ও ‘পত্রলেখা’য় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি। তিনি আমার জন্য একটা লার্নিং ইনস্টিটিউট ছিলেন। তার কাছে যা কিছু শিখেছি সেগুলো আমার জন্য এখনও সহায়ক হয়। স্বতস্ফূর্ত কিংবা সাবলীল অভিনয় কী ওটা তিনি খুব ভালোভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। প্রস্তুতি কী নেবো জানতে চাইলে বুদ্ধদেবদা আমাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে বলেছিলেন। ওটাও আমার জন্য একটা দীক্ষা। কবিগুরুর নারী চরিত্রগুলো কেমন হয় সেই ধারণা পেয়েছি।
বাংলানিউজ: বই পড়েন?
শিনা: বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়তে ভালো লাগে। বিজ্ঞান নিয়ে আরও শিখতে চাই। দর্শন আর কবিতাও পড়ি। তবে মিউজিক শুনতে খুব ভালো লাগে। রবীন্দ্রসংগীত শুনি। ক্লাসিক্যাল, ওয়েস্টার্নসহ সব ভালো লাগে মেজাজের ওপর।
বাংলানিউজ: ‘মিস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স—আই অ্যাম শি’ প্রতিযোগিতায় আপনার প্রশিক্ষক ছিলেন ১৯৯৪ সালের ‘মিস ইউনিভার্স’ সুস্মিতা সেন। তার কথা মনে পড়ে?
শিনা: সুস্মিতা সেন আমার মেন্টর ছিলেন। আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সব পরামর্শ পেয়েছি তার কাছ থেকে। আমরা একমাস একসঙ্গে ছিলাম। তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, নারীদেরকে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে হয়। আত্মবিশ্বাস রাখবে। তার কাছ যেগুলো শিখেছি তা এখনও প্রয়োগ করি। ২০১০ সালে এ প্রতিযোগিতায় ‘আই অ্যাম ভয়েস’ পুরস্কার জিতেছি। এ ছাড়া ‘মিস কলকাতা’ও হয়েছি।
বাংলানিউজ: আপনার প্রথম উপার্জনের কথা বলুন।
শিনা: ‘মিস কলকাতা’ হওয়ার পর একটা বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করে পাঁচ হাজার রুপি পেয়েছিলাম। খুব আনন্দ লেগেছে। তারপর ঘরে এসে ওটা মাকে দিয়ে দিলাম।
বাংলানিউজ: আপনি তো মঞ্চনাটকও করেছেন...
শিনা: পর্দায় আমাকে যা দেখেন এর নেপথ্যে আছে আমার নাট্যচর্চা। পাঁচ বছর কলকাতা পদাতিকে কাজ করেছি। এ দলের প্রযোজনা উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ নাটকে অভিনয় করা হয়েছে। দিল্লিতে নাট্যগুরু অরবিন্দ গৌরের কাছে শিখেছি। পথনাটকও করেছি। আমার তো মনে হয়, পথনাটকই একজন শিল্পীকে ঘষেমেজে তৈরি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৬
জেএইচ