ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

চলনবিলাঞ্চলে বিলুপ্ত হচ্ছে মাছ, কমছে উৎপাদন

স্বপন দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৩
চলনবিলাঞ্চলে বিলুপ্ত হচ্ছে মাছ, কমছে উৎপাদন

নাটোর: মাছে ভাতে বাঙালি- বাংলার চিরায়ত প্রবাদ। প্রতিদিন খাবারের মেনুতে একটুকরো মাছ ছাড়া চলে না বাঙালির।

সারা দেশ জুড়ে বিছিয়ে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়। এসব জলাশয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য মাছ। তাই দেশে উৎপাদিত মাছেই প্রতিবছর মিটে যায় সিংহভাগ মাছের চাহিদা।

তবে আশংকার বিষয় এই যে, প্রকৃতি-পরিবেশের উপর মানুষের নানামুখী হস্তক্ষেপের কারণে ইদানীং কমতে শুরু করেছে মাছের উৎস। একইসঙ্গে হুমকির মুখে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কিছু মাছ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সম্পূর্ণরূপে। আর বিলুপ্তির পথে এমন মাছের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
 
দেশে উৎপাদিত মোট মাছের অন্যতম প্রধান উৎস রাজশাহীর চলনবিলাঞ্চল। কিন্তু প্রতিবছর কমছে এ অঞ্চলের মাছের উৎপাদন, বিলুপ্ত হচ্ছে মাছের প্রজাতি।

জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মানসম্মত পোনার অভাব, ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল অঞ্চলে গত ৩০ বছরে মাছের উৎপাদন কমেছে ৬৩ শতাংশ। আর এসময় বিলুপ্ত হয়েছে ২৫ প্রজাতির মাছ।
Cholonbil
জেলা মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৮২ সালে চলনবিলে প্রাকৃতিক মাছের উৎপাদন ছিল ২৬ হাজার ৯৯০ মেট্রিকটন, ১৯৯২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৭০০ মেট্রিকটনে। ২০০২ সালে ১২ হাজার ৬৬০ মেট্রিকটন এবং ২০০৯ সালে কমে দাঁড়ায় ১০ হাজার মেট্রিকটন। এভাবে ক্রমান্নয়ে কমে যাচ্ছে মাছের উৎপাদন।

বিল এলাকায় প্রাকৃতিক জলাভূমির পানির স্বাভাভিক প্রবাহ বাধগ্রস্ত হওয়া, পানির পরিমাণ কমে যাওয়া বা পানিশূন্য হয়ে পড়া, বিলাঞ্চলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করা ফসল চাষ এবং ডিমওয়ালা মাছ মেরে ফেলার কারণে প্রাকৃতিক দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে।

সবশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ অঞ্চলে বিলুপ্ত হয়েছে ২৫ প্রজাতির মাছ। এগুলো হলো- গাঙচিংড়ি, মাগুর, পাবদা, কৈ, (বিলুপ্তির পথে) খরশাল, লেটুকি, বাঁশপাতা, পাতাশি,  নান্দিনা, ভাঙ্গন, ঘোড়া, মহাশোল, তিলাশোল, ভ্যাদা, গজার, রেনুয়া, সরপুটি, রিঠা, বাছা, দেশি পাঙ্গাস, আইড়, ভেদা, বাটা ও রাইখ  মাছ।

জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নাটোর সদর, সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা ও ফরিদপুর উপজেলার অংশ বিশেষ, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলার অংশবিশেষ, নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর, রাজশাহীর বাগমারা ও বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত এ বিলটির আয়তন ছিল প্রায় ৭৩ হাজার পাঁচ শ’ হেক্টর। কিন্তু বর্তমানে নানা প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সংকুচিত এ বিলের আয়তন এসে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার হেক্টরে।

চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ছোট বড় ৩১টি নদ-নদী। খালের সংখ্যা ৩৭টি। বিল রয়েছে ১৭টি। বিল ও নদীতে মৎস্য বিভাগের অভয় আশ্রম ৩০টি। কিন্তু ওইসব নদী-খাল-বিল-অভয়াশ্রমের মাছ মৎস্য সংরক্ষণ আইন না মেনে নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জাল দিয়ে ছোট বড় সব ধরনের মাছ ধরা হয়। ফলে একদিকে যেমন মা মাছ মানুষের খাদ্য হয়ে যায়, অপরদিকে ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায় না।
 
চলনবিল এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড খাল খনন, বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এর ফলে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হয়। মাছের চলাচল, প্রজনন, ও বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়। উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনের জন্য আশির দশকে চলনবিল এলাকায় প্রায় সাত হাজার যন্ত্রচালিত নলকূপ বসানো হয়। এর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নদী-খাল-বিলে পানির স্থায়ীত্বকাল কমে আসে। ফসলের জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও বৃদ্ধি সরাসরি বাধাগ্রস্ত হয়।

কারেন্ট, বাঁধাই, সোঁতি প্রভৃতি অবৈধ জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরা, মাছের প্রজননকালীন সময়ে গরিব মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা, জেলেদের অজ্ঞতা, জলাশয় ভরাট করে নানা ভবন-স্থাপনা নির্মাণ প্রভৃতি কারণে চলনবিল অঞ্চলে মাছের উৎপাদন আশংকাজনক হারে কমে গেছে।
Cholonbil
জেলার ১৮ হাজার মৎস্যচাষির অধিকাংশই আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের চাষ করছেন। গত বছর জেলায় মাছের চাহিদা ছিল ২৭ হাজার ১৫০ টন। উৎপাদন হয়েছে ৩৩ হাজার ৮৮৬ টন। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নাটোরে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় মৎস্যচাষিদের প্রশিক্ষণ, নার্সারি স্থাপন, জাল ও পিলেট মেশিন প্রদান, পানি পরীক্ষা, পরামর্শ ও মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। এর জন্য ব্যয় হয় ৩১ লাখ টাকা।

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকার জনগণের জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের আওতায় অভয়াশ্রম স্থাপন, পোনা অবমুক্তি, বিকল্প আয়বর্ধক কর্মসূচি, জলাশয় পুনর্খনন, সমিতি গঠন ও তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয়। । এর জন্য ব্যয় হয় ১৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।

প্রায় একই উদ্দেশ্যে ১২ লাখ ৩১ হাজার টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয় চিহ্নিত অবক্ষয়িত জলাশয় উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। অভিন্ন উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প এবং অন্যান্য জলাশয় সমন্বিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প। এর জন্য খরচ হয়েছে ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

মাছে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। প্রকল্পগুলি প্রায় এক ও অভিন্ন। সুতরাং কোন প্রকল্পে কে উপকার ভোগ করছে, তা জানা কষ্টকর। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়া সত্ত্বেও বাজারে মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, দামও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

তবে মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, নানা সমস্যার কারণে মাছের উৎপাদন আশানুরূপ হচ্ছে না। মৎস্য অধিদপ্তরে দক্ষ জনবলের অভাব, মাছের জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গবেষণার অভাব, অপ্রতুল বাজেট, মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয় না। বাণিজ্যিকহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করা হয়। কৃষি জমির খাজনা প্রতি শতাংশ দুই টাকা, অথচ পুকুরের খাজনা ১৫ টাকা।

নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল ইসলাম জানান, নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের ব্যবস্থাপনা ভূমি মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে মৎস্য মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর, উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সংরক্ষণ-আহরণে স্থানীয় মৎস্যজীবী ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা, খনন করা এবং সরকারি জলাশয়ের দশ শতাংশ অভয়াশ্রম হিসেবে ব্যবহার করলে মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়বে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।