ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

আধুনিক যুগের ব্যাঙকুমারের গল্প

মো. আশরাফুল আলম, বাকৃবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৩
আধুনিক যুগের ব্যাঙকুমারের গল্প

রূপকথার ব্যাঙকুমারের কথা আমাদের কারো অজানা নয়। তবে এখানে রূপকথার ব্যাঙকুমার, যে ব্যাঙের বেশে থাকত তার কথা বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে সেই ব্যাঙকুমারের কথা যিনি ব্যাঙের প্রজাতি নির্ণয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে  যাচ্ছেন।



ব্যাঙ নিয়ে তেমন কেউ গবেষণা করতে চান না। আর বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা করা কঠিন এবং অনেকের কাছে তা হাস্যকর মনে হতে পারে। তবে যেকোন দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা দরকার।

এটি একদিকে প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার পাশাপাশি ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। প্রকৃতিতে বিরাজমান প্রাণিকুলের মধ্যে রয়েছে নানা বৈচিত্র্যময়তা। ব্যাঙ তেমনই একটি উভচর প্রাণী।

ব্যাঙ প্রত্যক্ষভাবে মানুষের উপকার না করলেও পরোক্ষভাবে কীটপতঙ্গ খেয়ে মানবকুলের বন্ধু হয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করছে। প্রাকৃতিক নানা কারণে ব্যাঙের প্রজণন ক্ষেত্র মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে। দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে ব্যাঙের বিভিন্ন প্রজাতি।

ব্যাঙের বাসস্থান, খাদ্য ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে অবজ্ঞার কারণে ব্যাঙের বিচরণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হচ্ছে। অথচ এক সময় বাংলাদেশ ব্যাঙের পা রপ্তানি করে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করত। কিন্তু ব্যাঙ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য, গবেষণা ও বাণিজ্যিক ভিতিত্তে উৎপাদন পরিকল্পনা না করেই সরকার ব্যাঙ ধরা এবং রপ্তানি বন্ধ করে দেয়।

ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের(বাকৃবি) মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক শেষ করে ২০০৬ সালে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তরুণ বিজ্ঞানী মাহমুদুল হাসান।

মাছ নিয়ে গবেষণায় হাতে খড়ি হলেও পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে ব্যাঙের সাথে পরিচয়, তারপর থেকেই ব্যাঙ সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ আর সর্বোপরি গবেষণা।

ব্যাঙ নিয়ে গবেষণায় তাঁকে প্রেরণা যুগিয়েছেন বাকৃবির মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক ড. মো. মোখলেছুর রহমান খান। পরে তিনি ব্যাঙ নিয়ে গবেষণার জন্য পাড়ি জমান জাপানে।

তিনি সেখানে “ইনস্টিটিউট অফ এম্পিবিয়ান বাইলোজি” বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারপর থেকেই ব্যাঙ হয়ে ওঠে হাসানের নিত্য সঙ্গী। তিনি গবেষণার এক পর্যায়ে উপলব্ধি করেন কত প্রজাতির ব্যাঙ বাংলাদেশে আছে তার সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর কোন উত্তর নেই।

একেক রিপোর্টে একেক রকম তথ্য দায়সারা গোছে ব্যাঙকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এতে প্রয়োগ করা হয় নাই কোনো সঠিক সিস্টেমেটিক কিংবা মলিকুলার পদ্ধতি। ফলে অনেক ভুল-ভ্রান্তি রয়ে গেছে।

তবে একথাও সত্য যে, বাংলাদেশে মলিকুলার পর্যায়ে কাজ করে ব্যাঙের সঠিক প্রজাতি নির্ধারণ করার মত সুযোগ-সুবিধা এখনও তৈরি হয়নি। ফলে অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার বৈচিত্রময় এম্পিবিয়ান সেক্টর। কিন্তু হাসান বর্তমানে যে গবেষণাগারে কর্মরত আছেন সেখানে এই ধরনের কাজ করার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি।

পর্যায়ক্রমে হাসান শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের ব্যাঙের প্রজাতি সনাক্ত করার কাজটি। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে তিনি বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য প্রায় সকল প্রজাতির ব্যাঙ জীবিত বা মৃত অথবা শুধুমাত্র পায়ের নখের একটু অংশ (DNA) জাপানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর শুরু করেন নিবিড় গবেষণা।

এক এক করে সবগুলো প্রজাতি সনাক্তকরণের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের সমস্ত ব্যাঙ নিয়ে ২০১২ সালে Criptic Anuran Biodivensity in Bangladesh Revealed by Mitochondrial 16s rRNA Gene Sequences শিরোনামে একটি নিবন্ধন তৈরী করেন এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে (Zoological Science, volume 29, page: 162-172) প্রকাশ করেন।

তিনি নিবন্ধ ফলাফল থেকে পান বাংলাদেশে ব্যাঙের মোট প্রজাতির সংখ্যা ৪৩টির বেশী, যার মধ্যে ৮টি ক্রিপটিক প্রজাতি(অনাবিস্কৃত)। গবেষণার সেই ধারাবাহিকতায় তিনি সেই ৮টি আবিস্কৃত ব্যাঙ থেকে ১টি ব্যাঙ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যথা: ব্যাঙের সিস্টোমেটিক, মলিকুলার এবং ডাকের শব্দ বিশ্লেষণ করে অনন্য ব্যাঙটিকে নতুন প্রজাতি বলে দাবি করেন।

সেই গবেষণার ফল নিবন্ধন আকারে যার শিরোনাম ছিল A new species of genus Hoplobatrachus (Anuran Dicroglossidea) from the coastal belt of Bangladesh যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জার্নাল Zootaxa তে জমা দিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যাঙ বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ ৬ মাস যাচাই বাছাই করে হাসানের দাবি মেনে নেন এবং তা Zootaxa জার্নালের ৩৩১২ তম ভলিউমের ৪৫-৪৮ পৃষ্ঠায় ছাঁপা হয়।

যেহেতু ব্যাঙটি বাংলাদেশের কক্সবাজারের উকূলীয় এলাকা টেকনাফ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। তাই জায়গার নামনুসারে হাসান ব্যাঙটির নামকরণ করেন Hoplobatrachus Litoralis . Litoralis ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ উপকূল। এই ব্যাঙটির ১৫০ বছর পর ফ্যামিলি Dicroglossidea এর Hoplobatrachus এ অন্তর্ভূক্ত হয়।

এম্পিবিয়ান গবেষণায় তরুণ এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর কৃতিত্ব হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে “INNOVATION” ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। বর্তমানে তিনি আরও দুটি নতুন প্রজাতির নামকরণ নিয়ে গবেষণার শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন।

এসব সাফল্য নিয়ে তিনি অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। বর্তমানে তিনি গবেষক হিসাবে একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। ড. হাসানের জন্ম নরসিংদীর মনোহরদীতে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৩
এনএস/ এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।