ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

একমাত্র জলাবনে বিপন্ন জীবন

মীর সানজিদা আলম ও সাব্বির আহমদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৩
একমাত্র জলাবনে বিপন্ন জীবন

সিলেট থেকে ফিরে: একে তো বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, তারওপর সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তবুও উদাসীন বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন।

যেন কোন দায়ই নেই কারো। তাই শান্তি বা স্বস্তিতে নেই বন্যপ্রাণী। বিপন্নপ্রায় হিজল-কড়চের সারিও। সব মিলিয়ে দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাবন ‘রাতারগুল এখন হুমকির মুখে। ভেঙে পড়ছে বাস্তু ব্যবস্থা। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

পর্যটকদের অবাধ যাওয়া- আসা, বনের ভেতর উচ্চ আওয়াজে মাইক বাজানো, বিস্কিট, চিপস, পানির বোতল বা ক্যান যেন এই জলাবনে  প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রাণী আর বৃক্ষের জীবনচক্রে নিদারুণ এক পরিহাস। স্বাভাবিকতার ওপর মারণ আঘাতও বটে।

তিন হাজার তিনশ’ ২৫.৬১ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এ বনভূমিকে ১৯৭৩ সালে ‘বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করে বন বিভাগ। বন্য প্রাণীর এ অভয়ারণ্য আবার রিজার্ভ ফরেস্টও। কিন্তু সরেজমিনে ঘুরে এমন একটা দৃশ্যও চোখে পড়ল না যে আমরা কোনোভাবে একে অভয়ারণ্য বা রিজার্ভ ফরেস্ট বলতে পারি।

রিজার্ভ ফরেস্ট হল সংরক্ষিত বন এলাকা। ১৯২৭ সালের ইনডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট অনুসারে সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে রিজার্ভ ফরেস্টে গাছ কাটা বা যে কোনো ধরনের বন্যপ্রাণী ধরা নিষিদ্ধ। অন্যদিকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বলতে এমন একটা জায়গাকে বোঝায় যেখানে সব প্রাণী একা অথবা দলগতভাবে অবাধ ও নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারবে।

যেখানে তার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা থাকবে। বাইরে থেকে কোনো প্রাণী এনে সংরক্ষণ করা হলেও প্রাণীদের বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকবে।

কিন্তু এ বনভূমিকে অভয়ারণ্য বা রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এটি সংরক্ষণে নেই কোনো সরকারি তৎপরতা। সরকারিভাবে একটা বিট অফিস বা রেঞ্জ অফিস থাকলেও সেখানে নেই পর্যাপ্ত জনবল। একজন বিট অফিসার বা রেঞ্জ অফিসার এবং দুইজন বনরক্ষী নিয়েই চলছে রাতারগুল বিট অফিস।

সোয়াম্প ফরেস্টকে সরকারিভাবে সোয়াম্প ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিস সূত্র জানায়, রাতারগুলকে সরকারিভাবে সোয়াম্প ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। কোনো সরকারি গেজেট বা ঘোষণাও আসেনি।

রিজার্ভ ফরেস্ট  বা  বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হতে গেলে কোন কোন বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এ বিষয়ে  শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনএক্সপ্লো’র সভাপতি অনিমেষ ঘোষ ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালযের প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘প্রাধিকার’র সাধারণ সম্পাদক জয় প্রকাশ জানান,  কোনো বনকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করলে, প্রথমেই একে বাফার জোন এবং কোর জোন এ দুই ভাগে ভাগ করে দিতে হবে।

বাফার জোন হল যেখানে সাধারণের বা ট্যুরিস্টদের প্রবেশাধিকার থাকবে। একটা নির্দিষ্ট ট্রেইল বা রাস্তা দিয়ে তারা চলাচল করতে পারবে। আর ‘কোর’ জোন সংরক্ষিত থাকবে। যেখানে কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না।

এ বিষয়ে গ্রিনএক্সপ্লো’র সভাপতি অনিমেষ ঘোষ বলেন, দিন দিন রাতারগুলের পরিবেশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে পানি, মাটি ও শব্দ দূষণ। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। শুকনো মৌসুমে পলিথিন আর প্লাস্টিকের বোতল বা ক্যানের কারণে গাছের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

‘প্রাধিকার’র সাধারণ সম্পাদক জয় প্রকাশ জানান, বনের ভেতর চিৎকার, উচ্চস্বরের আওয়াজ বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত করে। এতে তারা ভয় পেয়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে এবং তাদের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।

এসব বিষয়ে জানতে রাতারগুল বিট অফিসে গেলে বিট অফিসারকে পাওয়া যায়নি। পরে সেখানে দায়িত্বরত বনরক্ষী বজলুল রশিদের কাছে পরিবেশ সংরক্ষণের কথা জানতে চাইলে এবং পলিথিন নিষ্কাশনের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পলিথিন পরিষ্কার করা আমাদের দায়িত্ব না। ’

কাদের দায়িত্ব এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি।

গাছ কাটা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তাদের কাছে গাছ কাটা বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। যদি এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় বা হাতে-নাতে কেউ ধরা পড়ে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এবং গাছের টুকরো বিট অফিসে নিয়ে আসা হয়।

পরে রাতারগুল বিট অফিসার আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। আমাদের এখানে জনবল বৃদ্ধি করার জন্য। এত অল্প জনবল দিয়ে আসলে কিছু করা যায় না। এতদিন এত প্রচার ছিলো না। এখন প্রচার হচ্ছে আশা করছি সরকার আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদটি রক্ষার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

রাতারগুল নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার (ডিএফও) আবুল বাশার মিয়া বলেন, রাতারগুলকে সরকারিভাবে সোয়াম্প ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা না করা হলেও  একে ন্যাশনাল ফরেস্ট করার  জোর পদক্ষেপ চলছে। সেজন্য সাড়ে ৫ কোটি টাকার একটা বাজেট করে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি।

বরাদ্দ পেলে কিভাবে তা এখানকার উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা হবে এ বিষয়ে তিনি বলেন, কো-ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এ বনকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাদের বোঝাতে হবে এ বন তাদের। এ বন রক্ষা করতেও হবে তাদের।  

ন্যাশনাল পার্কের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তিনি বলেন, সবার আগে এ বনের আশপাশে স্থানীয় জনগণকে এ বনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।   নেপালের একটা ন্যাশনাল পার্ক আছে। যার আশপাশে প্রচুর জনবসতি। স্থানীয় জনগণ সে বনের ওপরই নির্ভর্শীল ছিল। পরে যখন সে পার্ককে রিজার্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হল তখন স্থানীয় জনগণকে পর্যটকদের গাইড হিসেবে নিযুক্ত করে এবং  ফরেস্ট সংক্রান্ত অন্যকাজে তাদের নিয়োজিত করা হয়। এখন তারা নিজেরাই বহিরাগত লোকদের থেকে সেই বন রক্ষা করছে।

একইভাবে রাতারগুলের আশপাশের লোকজনকেও বোঝাতে হবে যে এটা করতে পারলে তারা লাভবান হবে। তারা যে বনের ওপর নির্ভর করে এতদিন চলেছে। সে বনেই তাদের অর্থনৈতিক পাথেয় হবে। শুধু ধরনের পরিবর্তন হবে।
 
এছাড়া একটা নিদিষ্ট রুট পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। বাকিটা প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে রাখতে হবে। যে এলাকাটায় বন্যপ্রাণী বিচরণ করবে তার অন্তত এক কিলোমিটার পর্যন্ত যাতে সাধারণ পর্যটকরা প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বন্যপ্রাণী কমে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‌এখন বর্ষাকাল বিধায় আপনারা শিয়াল, মেছো বাঘসহ অন্য প্রাণী দেখতে পাবেন না। সাপ-ব্যাঙ এসব সরীসৃপ দেখতে পাবেন। ’     

এখানে বাইরে থেকে কোনো প্রাণী আনা হবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, না আপাতত সেরকম কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা এখানকার স্থানীয় প্রাণীগুলোকে রক্ষার চেষ্টা করব। যেটাকে domestic indigenous বলে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১৩
জেডএম/ এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।