ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

আমন ধানে বিপর্যয়, দিশেহারা কৃষক

রফিকুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
আমন ধানে বিপর্যয়, দিশেহারা কৃষক

ভোলা: খাদ্য সংগ্রহের মৌসুমের শুরুতেই আমন ধানে বিপর্যয় নেমে এসেছে দ্বীপজেলা ভোলায়। আবাদ মৌসুমের শেষদিন অবধি জেলার বহু কৃষক আমন চাষ করতে পারেনি।

ঋণ নেওয়া অর্থ পরিশোধ আর সামনের মৌসুমের খাদ্য সংগ্রহের চিন্তায় এখন দিশেহারা কৃষক।

সরেজমিনে ভোলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আমন আবাদের সব চেষ্টাই এবারে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ দুইবার আবার কেউ তিনবার আমন ফসল আবাদের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রকৃতির কাছে হার মেনেছেন তারা।

হিসাব কষে দেখা গেছে, এবার আমন উৎপাদনে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ৩০ হাজার আবার কেউ ৬০ হাজার টাকা গচ্চা দিয়েছেন। এ টাকা তারা ব্যাংক কিংবা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। কেউ আবার নিজের সঞ্চিত টাকায়ও আমন আবাদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

ভোলা সদরের কাছিয়া গ্রামের ফরিদ আহমেদ দু’কানি (এককানি = সোয়া একর) জমিতে আমন আবাদের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষেতের পানিতে চারা পঁচে গেছে। অবশেষে চারা সংগ্রহের জন্য বরিশালেও গিয়েছেন। সেখানে চারা পাওয়া যায়নি। এখন ওই জমি খালি পড়ে আছে। অথচ আমন আবাদের জন্য তার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এ টাকা তিনি ধারকর্জ করে সংগ্রহ করেছিলেন।

ফরিদ আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, প্রতি বছরই কোনো না কোনোভাবে ফসল মার খায়। কখনও আবাদ মৌসুমে আবার কখনও ফসল কাটার মৌসুমে নানা ধরনের সংকট দেখা দেয়। সরকার এ এলাকার দুর্গত মানুষের জন্য কিছুই করে না। গরিবের খোঁজ কেউ রাখে না।

একই এলাকার আরেক কৃষক মোসলেহ উদ্দিন আড়াই কানি জমিতে আমন আবাদের উদ্যোগ নেন। কিন্তু প্রবল জোয়ারের প্রভাবে আবাদ করতে পারেননি। জমির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা ঋণ করে আনা। এখন কী দিয়ে এ ঋণ পরিশোধ করবেন জানা নেই তার। তার জমিতে প্রতি বছর যে পরিমাণ  আমন হতো, সে জমি এখন পতিত থাকবে। সুযোগ পেলে শীত মৌসুমে কিছু সবজি আবাদ করবেন।

সদর ভোলার কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, ফসলি মাঠে এখনও জোয়ারের পানি জমে আছে। চারিদিকে গ্রামের মাঝখানে খোলা জায়গায় এখন আমনের সবুজ ক্ষেত থাকার কথা থাকলেও সেখানে এখন থইথই পানি। পরাণগঞ্জ, কাছিয়া, ইলিশা, ধনিয়া ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার চিত্র একই।

এবার জোয়ারের পানিতে আমন আবাদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন কৃষকরা। অন্য কোনো বছর এমন ক্ষতি হয়নি। অনেক কষ্টে কেউ কেউ আমন আবাদ করতে পারলেও, তাতে ফলন কতটা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

কৃষক কামাল হোসেন দু’বছর ধরে জমিতে আমন আবাদ করতে পারছেন না। দু’কানি জমিতে আমন আবাদের চেষ্টা করেছিলেন। ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। একইভাবে গত বছরও আমন মৌসুমে তার লোকসান হয়েছিল প্রায় এক লাখ টাকা। আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

এমনই চিত্র ভোলা সদর, দৌলতখান আর বোরহানউদ্দিন উপজেলার কৃষকদের। শুধু এ তিন উপজেলায় নয়, জোয়ারের পানিতে ফসলি মাঠ ডুবে থাকার প্রভাব পড়েছে পুরো জেলায়। ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এবার জলাবদ্ধতার কারণে জেলায় ৫ হাজার ২৪২ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ কম হচ্ছে।

সূত্র বলেছে, ভোলা সদর উপজেলায় ২৫ হাজার ৫০০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৫ হাজার ৪৫০ হেক্টরে, দৌলতখানে ১৩ হাজার হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৩ হাজার ৬০ হেক্টরে, বোরহানউদ্দিনে ২০ হাজার ৫০০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৩ হাজার হেক্টরে, তজুমদ্দিনে ১০ হাজার হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৮ হাজার ৩২৫ হেক্টরে, লালমোহনে ২৫ হাজার ৫০ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২৫ হাজার ৬০০ হেক্টরে, চরফ্যাশনে ৭২ হাজার ১৭৭ হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭৫ হাজার ৩০০ হেক্টরে এবং মনপুরায় ১২ হাজার হেক্টরের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১২ হাজার ২৫০ হেক্টরে আমন আবাদ হয়েছে।

কয়েকটি উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হলেও সামগ্রিকভাবে এর আগে জেলায় আমন ধানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। উপকূলের কৃষক পরিবারের জন্য আমন হচ্ছে খাদ্য সংগ্রহের মৌসুম।

বছরের বেশিরভাগ সময়ের খাদ্য এ সময়ে মজুত করা হয়। এ ফসল মার খাওয়া মানে খাদ্য মজুত করতে না পারা। এ কারণে ধারকর্জ করে হলেও কৃষকরা অতিকষ্টে আমন আবাদ করে। ফলন পেয়ে ধারকর্জের টাকা পরিশোধ করে তারা। ভাদ্র মাসের শেষ আর ইংরেজি সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমন ধানের আবাদ শেষ হয়। এরপর আমন আবাদের আর কোনো সুযোগ থাকে না।

কৃষকদের অভিযোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল আবাদের প্রায় সব মৌসুমই বদলে গেছে। ফলে কৃষিতে দেখা দিয়েছে নানামুখী সংকট। দুর্যোগের পর দুর্যোগ এলেও সহায়তা মেলে না। এক মৌসুমের ক্ষতি পরের মৌসুমে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা সরকার করলেও তা খুব কম সংখ্যক কৃষকের হাতেই পৌঁছায়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শান্তিরঞ্জন মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার পদক্ষেপ নেয়। স্থানীয় পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়। সেখান থেকে কৃষকদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের পর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হলে কৃষকদের জন্য উফশী বীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা বরাদ্দ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/এসএটি/এমজেএফ/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।