ময়মনসিংহ: বৃহত্তর ময়মনসিংহের ভাওয়াল ও মধুপুর গড় উজাড় হয়ে যাওয়ায় বিপন্নের পথে বৃহত্তর ময়মনসিংহের নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। এরই মধ্যে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী।
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ভাওয়াল এবং মধুপুর গড় এক সময় উভচর, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীতে ভরপুর ছিল। কিন্তু বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক আবাসস্থল ও বসবাসের উপযোগী পরিবেশের অভাবে তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন। গড় অঞ্চলসহ বৃহ্ত্তর ময়মনসিংহের বন্যপ্রাণীর বিষয়ে জরিপ বা তালিকা না হওয়ায় তাদের বর্তমান সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত প্রাণী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের মধ্যে ১৮৭৭ সালে জাভা দেশীয়/ছোট একশৃঙ্গী গন্ডার, ১৯০৮ সালে ভারতীয়/বড় একশৃঙ্গী গন্ডার, ১৯৪৫ সালে বুনো মোষ, ১৯৫৪ সালে জলার হরিণ/বারশিঙ্গা ও ১৯৭১ সালে গৌর/ বন গরু পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এর ফলে এ জাতগুলোকে বিলুপ্ত বলে প্রাণীবিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ কেদারনাথ মজুমদার তার ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাখির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন- মানিকজোড়, ময়ূর, ধনঞ্জয়, ভৃঙ্গরাজ, বনমোরগ, ময়না, টিয়া, মদনা, তোতা প্রভৃতি যাবতীয় পক্ষীই সুসঙ্গের পাহাড় এবং ভাওয়াল ও মধুপুরের জঙ্গলে পাওয়া যায়। অথচ এখন আর সেই পাখিদের দেখা মেলে না।
ময়মনসিংহের সরকারী আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ সূত্র জানায়, এক সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলে নানা জাতের ও বৈচিত্র্যময় পাখির বসবাসস্থান ছিল। খাদ্য শৃঙ্খলের উপযোগীতা থাকায় এখানে নানা জাতের বন্যপ্রাণীর আবাস ছিল।
একশ’ বছর আগেও এ দু’টি গড়ে উভচর প্রাণীর মধ্যে কোনোব্যাঙ, সোনা বা সবুজ ব্যাঙ, কটকটি বা গেছো ব্যাঙের অবারিত বাস ছিল। সরীসৃপ শ্র্রেণির মধ্যে কুমির, শুশক, কচ্ছপ, কাছিম ও নানাজাতের সাপ দেখা যেত। সাপের মধ্যে গোখরা, জাত, দাঁড়াস, ঢোঁরা এমনকি বড় জাতের অজগরেরও অস্তিত্ব ছিল।
সূত্র জানায়, এখনো মধুপুর গড়ে বানর, হনুমান, সজারু, গুইসাপ, বেজী ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ জেলার গড় অঞ্চল ছাড়াও ফুলপুর ও ভালুকা উপজেলায় এক সময় প্রচুর উদবিড়াল দেখা যেত। স্থানীয় মৎস্য শিকারীরা উদবিড়ালকে মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করত। নদ-নদীতে শুশকের পাশাপাশি কুমিরও ছিল।
একই সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পৌনে এক শতাব্দী কাল আগেও ময়মনসিংহে ময়ূর পাওয়া যেতো। আঞ্চলিকভাবে সোনাজঙ্ঘা নামে পরিচিত চিত্রিত বক এখানকার বিল-ঝিল, জলাশয়, জলমগ্ন ও নদীর তীরে অবাধ বিচরণ করত। রাজশকুন ও এর সমান বড় হারগিলা বৃহৎ ও কুৎসিত আকৃতির পরিচিত বক পাখিটিও ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে।
এছাড়া গড় অঞ্চল থেকে বন্যহাতি, বনগরু, বনমহিষ, বনছাগল, বনমোরগ, বাঘ জাতীয় প্রাণী, সজারু, বানর, হরিণ, ভাল্লুক, কুমির বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্ব বর্তমানে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের পশু বিজ্ঞান বিভাগ সূত্র মতে, যখন থেকে ব্যাপকহারে বনজঙ্গলের গাছপালা কেটে ও জলাভূমি-ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ জায়গায় বসতি গড়তে শুরু হয় সেই সময় থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহে বন্যপ্রাণীর প্রকার বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এসএম আকবর জানান, শুধুমাত্র গড় অঞ্চলই নয়- বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলই ছিল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এ এলাকাতেই সবচেয়ে বেশী মেরুদন্ডী প্রাণী বসবাস করত।
ময়মনসিংহের গড় অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীন পরিবেশ দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময় ১১১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩
এসএস/এমজেডআর