উপকূল ঘুরে: কেউ চায় শিক্ষক হতে, কারো চাওয়া ডাক্তার হওয়া। আবার কারো প্রত্যাশা পুলিশ বাহিনীর বড় কর্মকর্তা হওয়ার।
হতদরিদ্র পরিবারে বড় হওয়া শিশুদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কথা জানা গেল ভোলা সদরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপচর রামদাসপুরে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করলেও স্কুলে ভালো ফলাফল করেই এগিয়ে যাচ্ছে এ শিশুরা। রামদাসপুর দ্বীপটি নদীভাঙনে ছোট হয়ে এলেও এখানে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। সেখানেই পড়ছে বহু দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ে।
এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চতুর্থ শ্রেণির জাফর হোসেন, সোনিয়া আকতার, পঞ্চম শ্রেণির তছির উদ্দিন, নাছির উদ্দিন আর মোসা. সোনিয়া ছাড়াও অনেক শিক্ষার্থী কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। বাবা-ভাই কিংবা পরিবারের কেউই হয়তো স্কুলের চৌকাঠ পার হয়নি। অথচ সেই পরিবার থেকে ওরা লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অভিভাবকেরা কষ্ট করে হলেও ওদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান।
তাছির উদ্দিন আর নাছির উদ্দিন দুই ভাই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ ক্লাশ পঞ্চম শ্রেণিতে ছোটভাই তাছির উদ্দিনের রোল নম্বর এক, আর বড়ভাই নছির উদ্দিনের রোল নম্বর দুই্। তছিরের ইচ্ছা শিক্ষক হওয়ার। আর নাছির হতে চায় পুলিশের বড় কর্মকর্তা। সব বাঁধা অতিক্রম করে ওরা এগিয়ে যেতে চায়। শিক্ষকেরাও এদের প্রতি নিয়মিত নজর রাখেন। ওদের এগিয়ে যাওয়ায় গর্বিত স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ওদের বাবা জাহাঙ্গীর মাতবর অন্যের নৌকায় মাছ ধরে। বড় ভাই রাসেল মাতবরও বাবার কাজে সহায়তা করে। প্রতিদিন মাছধরার টাকা দিয়ে চাল কিনে চলে তাদের সংসার। ঘরে থাকার জায়গা নেই। পড়াশোনার স্থানের সংকট। তারপরও ওরা দুই ভাই কুপির বাতির আলোতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা অবধি পড়াশুনা করে। পড়া ঠিক করে স্কুলে আসে ঠিক সময়ে। কোনোমতে জোগাড় করেছে স্কুলে আসার কাপড়।
তাছির বলে, আমাগো তো কিছুই নাই। বাড়িঘর নদীতে নিয়া গেছে। বাবা নৌকায় মাছ ধরে। ভাইও বাবার সঙ্গে গেছে। আমরা লেখাপড়া করে বড় হতে চাই।
রামদাসপুরের হতদরিদ্র পরিবারের বড় হয়ে ওঠা মোসা. সোনিয়া কঠিন সংগ্রামে লেখাপড়া ধরে রেখেছে। পঞ্চম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর দুই। বাবা কামাল বেপারি অন্যের নৌকায় মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছেন অতিকষ্টে। সোনিয়া মনে করেন সব বাঁধা কেটে যাবে। একদিন লেখাপড়া করে ও অনেক বড় হবে। ওর স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার।
নিজের স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে সোনিয়া বলে, লেখাপড়া ছাড়া কোনো দান নাই। সংসারে অভাব অনটনের মধ্যেও স্কুলে আসি। পড়াশুনা করে যেতে চাই অনেক দূর।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া আক্তার। বার্ধক্যে ন্যূয়ে পড়া বাবা বজলু পালোয়ান কোনো কাজ করতে পারেন না। ছয় ভাইবোনের মধ্যে কেউই লেখাপড়া করতে পারেনি। দিন আনা দিন খাওয়া সেই পরিবার থেকে সোনিয়া অতিকষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে।
বিপন্ন এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে সোনিয়া শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। নদীতে বাড়ির জমি ভেঙেছে কয়েকবার, পরিবার ঋণী হয়েছে অনেক, পরিবারের এক একটি দিন কাটছে অতিকষ্টে। তারপরও সোনিয়ার লেখাপড়া থামেনি।
হতদরিদ্র পরিবারের উচ্চাশাধারী আরেক ছাত্র চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জাফর হোসেনের বাবা আবদুল খালেক হাওলাদারও অন্যের নৌকায় মাছ ধরে। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে জাফর তৃতীয়। চতুর্থ শ্রেণিতে ওর রোল নম্বর ১৫ হলেও মেধাবী ছাত্র হিসেবেই শিক্ষকদের কাছে পরিচিতি তার। রামদাসপুর চরের ছোট্ট ঝুপড়িতে বসবাস করেও স্কুলে আসে নিয়মিত। ওর ইচ্ছা ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করার।
সরেজমিনে রামদাসপুর চর ঘুরে দেখা গেল, অতিকষ্টে জীবন চললেও অনেকেই সন্তানদের প্রতি নজর রাখেন। অভাবে টানাটানির সংসারেও সন্তানকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছা তাদের। নিজেদের জীবন যেভাবেই হোক পার করেছেন, সন্তানদের জীবনে আর এ বোঝা তুলে দিতে চান না।
রামদাসপুরের একজন অভিভাবক মো. হারুন ষষ্ঠ শ্রেণি অবধি পড়েছেন। জমিজমা হারিয়ে এখন মুদি দোকান দিয়েছেন। পাঁচ ছেলে মেয়ে তার। ছেলে ছালেম উদ্দিন এবার এসএসসি পরিক্ষা দেবে। মেয়ে রাবেয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। হারুন বলেন, আমরা গরিব মানুষ। কোনোভাবে যদি ছেলেমেয়েকে এসএসসি পাস করাতে পারি, তাহলে ওরা ভালো থাকবে। লেখাপড়া জানা থাকলে মেয়ের জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যায়।
দক্ষিণ মধ্য রামদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এখানকার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়াতে সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আর তা হলেই শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের পথ সহজতর হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/আরকে