ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

খাদ্যাভাবে বিলুপ্তির পথে ‘ল্যাঞ্জা-রাতচরা’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৬
খাদ্যাভাবে বিলুপ্তির পথে ‘ল্যাঞ্জা-রাতচরা’ ছবি: ইনাম আল হক

রাতের সঙ্গে পাখিটির সম্পর্ক অতি নিবিড়। পৃথিবীর আলো নিভে এলেই তার ডানা মেলার সময় ঘনিয়ে আসে। সারাদিনের নিশ্চুপ বসে থাকা থেকে শিকারে বেরুবার তখনি যথার্থ মুহূর্ত।

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): রাতের সঙ্গে পাখিটির সম্পর্ক অতি নিবিড়। পৃথিবীর আলো নিভে এলেই তার ডানা মেলার সময় ঘনিয়ে আসে।

সারাদিনের নিশ্চুপ বসে থাকা থেকে শিকারে বেরুবার তখনি যথার্থ মুহূর্ত।

সন্ধ্যার আকাশ ‘রাতচরা’ পাখিটির বেঁচে থাকার উদ্যমকে প্রসারিত করে। আহ্বান জানায় ঘর ছেড়ে বেরুবার। এদের প্রধান খাবার মথ; যখন মথ রাতের অন্ধকারে সাদা ফুলের মধু আহরণ করতে ছুটে আসে তখনই তারা রাতচরার শিকারে পরিণত হয়।

ল্যাঞ্জা-রাতচরার গায়ের রঙ ঝরাপাতাদের মতোই। ধূসর শুকনো পাতার সাথে চুপটি করে বসে থাকে সে। তখন তাকে খুঁজে বের করা কঠিন। সারাদেশের বন-জঙ্গল বা বাঁশঝাড়ে এদের আজ খুবই কম দেখা মেলে।

রাতের আঁধারে প্রাকৃতিক নিঃস্তব্ধতার মাঝে ‘চৌঙ্ক-চৌঙ্ক-চৌঙ্ক’ স্বরে জোরে জোরে ডাকে। এ ডাকের সাথে কাঠুরিয়ার কাঠকাটার ক্রমাগত শব্দের দারুণ মিল রয়েছে। এ দুটো ডাক-ই বিরতিহীন ও অনিবার্য। প্রকৃতির আপন নীরবতার মাঝে যা বারংবার প্রতিধ্বনিত।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ল্যাঞ্জা-রাতচরা নিশাচর পাখি। এর ইংরেজি নাম Large-tailed Nightjar এবং বৈজ্ঞানিক নাম Caprimulgus macrurus। এরা রাতের পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে। রাতের পোকা মানে ‘মথ’। মথই এদের একমাত্র খাবার। পৃথিবীতে প্রজাপতি আছে ১৭ হাজার প্রজাতির। আর মথ রয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার প্রজাতির। কিন্তু এখন তাদের খাবার একেবারেই কমে গেছে বলে এ পাখিটিও হারিয়ে যাচ্ছে।

পাখিদের খাবার পোকামাকড় সম্পর্কে তিনি বলেন, আগে রাতে যখন বনে যেতাম টর্চ জ্বালালেই তখন লাখ লাখ পোকা মুখের উপর ঝাপিয়ে পড়তো। আর রাস্তার বাতির চারপাশে গোল হয়ে পোকাদের কুন্ডলি দেখা যেত। এখন এটা একেবারেই নেই। দিনের পর দিন মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে করে পোকামাকড় পুরোপুরিভাবেই শেষ করে ফেলেছি আমরা। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এই সব বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহারে আমাদের চারপাশ আজ বিপন্ন হয়ে গেছে। ফলে পোকার ওপরই যাদের জীবন নির্ভর করতো তারা এখন বিলুপ্তির পথে। তাদের মধ্যে প্রথমেই আছে এই নিশাচর পাখিটি রাতচরা।

পাখিটি নিয়ে স্মৃতিচারণ করে ইনাম আল হক বলেন, ১৫ বছর আগে শীতমৌসুমে লাউয়াছড়াতে গবেষণার কাজে এলে যেখানে এখন বিলাসবহুল আবাসন গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট তৈরি হয়েছে সেই মোড়ে সন্ধ্যার পর যেতাম। তখন আমাদের গাড়ির আলোতে দেখতাম এই ল্যাঞ্জা-রাতচরা পাখিগুলো রাস্তার বালুর উপর বসে রয়েছে। রাস্তার গরম উত্তাপ গায়ে লাগাবার জন্য ওরা রাস্তার উপর এভাবে বসে থাকতো। ওদের দেখার জন্যই আমরা সেখানে যেতাম।

‘আগে লাউয়াছড়াতে সন্ধ্যার পর গেলে সর্বত্রই ল্যাঞ্জা-রাতচরাদের ঘন ঘন ডাক শোনা যেত। এখন তো শুধু লাউয়াছড়াতেই কেন, সারাদেশের কোথাও তেমনভাবে এই পাখিটির ডাক প্রায় দশ বছর শুনি না’, বলেন পাখি বিজ্ঞানী ইনাম আল হক।
এই পরিবারের অন্যান্য পাখিদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাতচরা পরিবারের অন্যান্য পাখিগুলো হলো বড়-রাতচরা (Gray Eared Nightjar), মেটে-রাতচরা (Gray Nightjar), দেশি-রাতচরা (Indian Nightjar), মেঠো-রাতচরা (Savanna Nightjar)। ল্যাঞ্জা-রাতচরা এবং বড়-রাতচরা খুবই কম দেখা গেলেও বাকি রাতচরা তো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আমাদের দেশ থেকে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে গভীর সতর্ক দৃষ্টি রাখলে হয়তো এ পাখিটিকে হঠাৎ দেখা যেতে পারে।

ল্যাঞ্জা-রাতচরার দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার। এর সারাদেহে কালচে বাদামি নকশা। বসে থাকলে ডানায় তিন সারি বাদামি লাইন দেখা যায়। এর লেজ লম্বা ও প্রশস্ত। পুরুষ আর মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন। ল্যাঞ্জা রাতচরা সারাদিন মাটিতে ঝরাপাতায় বসে ঘুমায়। মার্চ-মে এদের প্রজননকাল। তখন মাটিতে শুকনো পাতার বাসা তৈরি করে মাত্র দুটো ডিম পাড়ে। দু’টি ছানা নিয়ে মাটিতে দিন কাটায় ল্যাঞ্জা-রাতচরা, জানান প্রখ্যাত এ পাখি বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৬
বিবিবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।