অপরিকল্পিত ও নির্বিচারে মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদ আহরণ, বিলের সঙ্গে সংযুক্ত অসংখ্য ছোট ছোট নালা ভরাট করে বাড়ি নির্মাণ, বিলের মধ্যে পানি ভরাট করে খামার ও বসত-বাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে বিলের প্রাণ মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদ। বিলের জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করেই বিল সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
স্থানীয়রা বাংলানিউজকে জানান, বাঘিয়ার বিলটিতে আগের মতো তেমন পানি হয় না। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিলে পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পানি প্রবেশের পথগুলো ভরাট করে বসতি স্থাপন করার কারণে এমনটা হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানের জলাশয় আবার ভরাটও করা হয়েছে। এতে করে বর্ষা মৌসুমেও পানি কম হয় বিলে।
স্থানীয়রা আরও জানান, শুকনো মৌসুমে বিলে ধানচাষ করা হয়। চাষাবাদের জন্য জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে বর্তমান সময়ে ঘাস নষ্ট করার জন্য অবাধে এক ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কারণে পানি হলে ওই বিষাক্ত ওষুধ বিলের পানিতে মিশে যাচ্ছে। ফলে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের প্রজনন নষ্টসহ মাছ মরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে মাছের পরিমাণ।
বর্ষার শুরুতেই শামুক-ঝিনুক, কচ্ছপ, পোনা মাছসহ শীতের সময় অতিথি পাখি শিকার করে এক শ্রেণির মানুষ উপার্জন করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ঐতিহ্য হারাচ্ছে বাঘিয়ার বিল।
স্থানীয় প্রবীণরা বাংলানিউজকে জানান, বাঘিয়ার বিল এলাকায় এক সময় কোনো জনবসতি ছিল না। মাদারীপুর, কোটালীপাড়াসহ আশেপাশের বিভিন্ন জেলার মৎস্যজীবীরা বর্ষা মৌসুমে বিলে এসে মাছ শিকার করতেন। এখানকার মাছসহ প্রাণিজ সম্পদের কদর ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরসহ দেশজুড়ে। স্থানীয়ভাবে দেশি মাছের চাহিদা মেটাতেও সক্ষম ছিল বাঘিয়ার বিল।
বাঘিয়ার বিল অঞ্চলে মূলত রাজৈরের আমগ্রাম, রাজৈর ও কদমবাড়ী এবং কোটালীপাড়ার কলাবাড়ী, রাধাগঞ্জ ও সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি গ্রামের অবস্থান এবং প্রায় ৩৫ হাজার লোকের বসবাস। বিলের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও আউশ-আমন ধানের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এসব এলাকার মানুষ।
ওই অঞ্চলে জেলেরা বাংলানিউজকে জানান, দেশি প্রজাতির মাছের মধ্যে বিলটিতে বর্তমানে তেমন একটা দেখা যায় না শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, খলিসা, পাবদা, বাইম, রয়না, শিং, মাগুর, আইড়, বোয়াল, চিতল, রুই, কাতল, টেংরা ইত্যাদি। জলজ উদ্ভিদ এবং কাঁকড়া, কুঁচিয়া ও কচ্ছপ জাতীয় অন্য প্রাণিসম্পদও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। নির্বিচার নিধনে হারিয়ে যেতে বসেছে শামুক-ঝিনুকও।
স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলী বাংলানিউজকে বলেন, শীত মৌসুমে বাঘিয়ার বিলে নানা রকম পাখি আসতো। এছাড়া সারা বছরই ডাহুক, পানকৌড়ি, বালি হাঁস, সরালি, বক, কাদাখোঁচা, মাছরাঙাসহ দেশীয় পাখি দেখা যেতো। বর্তমানে এসব পাখিও তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরে পুকুর, খাল-ডোবা, জলাশয় ভরাট করার হিড়িক পরে গেছে। এসব স্থানে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন। নদ-নদীর পানি খাল-বিলে প্রবাহিত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। দ্রুত নগরায়নের ফলে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ছে বসতি, ভরাট হচ্ছে জলাশয়। আর এ আগ্রাসনের জন্যই ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। বাঘিয়ার বিলও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশাল এই বিলের ঐতিহ্য হারাতে হারাতে হয়তোবা বিলটিও হারিয়ে যেতে পারে অদূর ভবিষতে!
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
এসআরএস