এভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার বাঁশ কাটার ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এ বনজসম্পদ ধ্বংসের ফলে বিরাট পরিবর্তনসূচক হয়ে দাঁড়িয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।
এর ফলস্বরূপ বাঁশকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা প্রাণীগুলোর অবস্থা বিপন্ন হবার উপক্রম। মহাবিপন্ন চশমাপড়া হনুমানসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এ বাঁশবনের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। তাছাড়া অবৈধভাবে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার বাঁশ কেটে নিয়ে যাবার ফলে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
রোববার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে চাউতলী বিটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জায়গায় জমা করে রাখা হয়েছে সদ্য কাটা বাঁশের স্তূপ। গহীন বনের নিস্তব্ধ পথ ধরে অগ্রসর হলে পথের মধ্যে শোনা গেছে, এদিক-ওদিক বাঁশ কাটার শব্দ। নানা ধরনের বুনো গাছগাছালি আর লতাগুল্মের সারি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেছে, আমাদের আসার শব্দ শুনেই দ্রুতবেগে পালিয়ে যায় চার-পাঁচজন বাঁশকর্তনকারী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী বাংলানিউজকে বলেন, চাউতলী ও কালাছড়া দুই বিটেরই অবস্থা এক। প্রতিদিন কম করে হলেও এককেটি বিটে ১৫-২০ জন লোক ঢুকে শুধু বাঁশ কাটার জন্য। প্রায় ৩০-৪০ জন লোক প্রতিদিন বনে ঢুকে নিজেদের ইচ্ছামতো বাঁশ কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বাঁশ কাটার জন্য জনপ্রতি ২০০ টাকা করে বন বিভাগকে দিতে হয়। একেক জন প্রায় ৮০ থেকে ১০০টি ছোট বাঁশ কেটে নিয়ে যায়। অধিকাংশই মিরতিঙ্গা বাঁশ (স্থানীয় ভাষায়)। তারপর মুলি ও কালী বাঁশও (স্থানীয় ভাষায়) রয়েছে। বাঁশ কাটার পাশাপাশি লাকড়ি শ্রমিকরাও (কাঠুরিয়া) ৫০ টাকা দিয়ে বনে ঢুকার সুযোগ পায়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন বনের ঠিক পাশের এ বিট দু’টোতে বাঁশবন সংরক্ষণ বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য কতোটুকু প্রয়োজনীয়- এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ বাংলানিউজকে বলেন, প্রাকৃতিক কোনো বন থেকে যেকোনো ধরনের বনজসম্পদ আহরণ করা যাবে না। সেটা একটা মৃত গাছই হোক না কেন। মৃত গাছও বন থেকে আহরণ করা যাবে না এটা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা। বাঁশের ওপর কিন্তু পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল আমাদের চশমাপড়া হনুমান (Phayer’s Leaf Mankey) ।
এছাড়া আমাদের এক প্রজাতির কাঠবিড়ালি আছে সেও বাঁশের ওপর নির্ভরশীল। ‘চুটকি’ (ফ্লাইকেচার) প্রজাতির যে পাখিগুলো আছে এরাও বাঁশ বাগানের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। এ পাখিগুলো বাঁশের পাতায় বসা বিভিন্ন ধরনের পোকা খেয়ে বেঁচে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া ‘বাঁশপাতি ঘুঘু’ (Common Emerald Dove) নামে এক ধরনের সুন্দর ঘুঘু পাখি আছে, যারা শুধু বাঁশ নির্ভরশীল বলে তার নামকরণও তাই হয়েছে। ‘নিমপেঁচা’ (Oriental Scops Owl) নামে এক প্রজাতির পেঁচা আছে যারা শুধু বাঁশ বাগানের পেঁচা। আমাদের দেশে একটা সাপ রয়েছে ‘বাশঁপাতালি সাপ’ বা ‘কালনাগিনী সাপ’ (Ornate Flying Snake)। এরা বাঁশবাগানকে কেন্দ্র করে টিকে থাকে। দেশের অনেক প্রাণী সরাসরি কিন্তু বাঁশের ওপর নির্ভরশীল। এভাবে বাঁশ কাটা হলে কিছু প্রাণী কিন্তু বন থেকে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
সুতরাং ফরেস্টে আমাদের মূল্যবান বন্যপ্রাণীর কথা চিন্তা করে বাঁশকে টিকিয়ে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান এ বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আ ন ম আবদুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্যপ্রাণীদের উন্নত প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য বাঁশবন বা ঝোপঝাড় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৯
বিবিবি/আরবি/