ঢাকা: ‘দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মর্যাদা বুঝি না’ প্রচলিত এ প্রবাদ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থবহ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য হতে পারে।
বনাঞ্চল অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রকৃতির অবধারিত অনুষঙ্গ বনপ্রাণীর সুরক্ষায় এর আগে নেওয়া একাধিক সরকারি উদ্যোগ রাখতে পারেনি তেমন কার্যকর ভূমিকা। বাংলাদেশে এক সময় বিপুল প্রাণিবৈচিত্র্য থাকলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের ব্যর্থতায় দিন দিন ছোট হয়েছে এর পরিসর। এমন বাস্তবতায় আবারও হাতে নেওয়া হয়েছে দেশের বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় বিশেষ প্রকল্প ।
‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন প্রজেক্ট’ নামে এ প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান ও ভারত অন্তর্ভূক্ত । বাংলাদেশে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৬ কোটি টাকা। বিশ্ব ব্যাংকের আইডিএ বিভাগ এই প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে। বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য রোধ করা, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান জোরদারকরণ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়নের কথা রয়েছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে । পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন বনবিভাগ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ করবে। ২০১১ সালের জুনে শুরু হওয়া এ প্রজেক্ট শেষ হবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে।
স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রটেকশন প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বাংলানিউজকে জানান, ‘সারাদেশের বন্যপ্রানী সংরক্ষণের জন্য এ প্রকল্পের মাধ্যমে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নতুন করে এ প্রকল্পের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। বাঘ-হাতির সাথে মানুষের সংঘাত লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। উপকরণ সুবিধা বাড়ানো করা হবে। সারাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে কাজ করলেও এ প্রকল্প সুন্দরবনের বাঘসহ অন্যান্য প্রাণিবৈচিত্র রক্ষায় বিশেষভাবে কাজ করবে। বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য ঠেকাতে এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনে প্রশিক্ষণ-গবেষণা কার্যক্রমও চালানো হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। জোরদার করা হবে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় আইনি কার্যক্রম।
ড. দে আরো জানান, ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর বর্তমান অবস্থা সংকটাপন্ন। বাঘের আক্রমণে মানুষ, আবার মানুষের হাতে বাঘের প্রাণহানি প্রায়ই ঘটছে। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন বনবিভাগে মানুষ-বাঘ সংঘর্ষে ২৪০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। বাঘ মারা পড়েছে মোট ৩৩টি। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বনবিভাগে জনবল নিয়োগ বন্ধ থাকায় এসব সংকট মোকাবেলায় বনবিভাগের সীমাবদ্ধতা তো রয়েছেই। বর্তমানে মামলা জটিলতায় নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় প্রায় ১৫শ’ পদ শূন্য রয়েছে। তবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা, নতুন করে বনায়ন, ইকো-ট্যুরিজমসহ নানা পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এসব সংকট অনেকটা লাঘব করা যাবে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন দেশের বন্যপ্রাণীদের বর্তমান অবস্থা ও বিশেষ এই প্রকল্পের নানা দিক নিয়ে।
ড. ইসলাম বাংলানিউজকে জানান,‘দেশের বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় এ প্রকল্প একটি বড় সুযোগ। একে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগানো গেলে তবেই অনেক সংকট দূর করা সম্ভব হবে। আমাদের একটি বড় দুর্বলতা হলো রিসোর্স ব্যবহারের অক্ষমতা। বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষনে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া লোকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে প্রকল্পের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছানো যাবে না। ’
দেশের বন্যপ্রাণীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, ‘খুব সুসংবাদ আছে বলে মনে করি না। বন্যপ্রাণীদের ব্যাপারে বর্তমান যে পরিসংখ্যান রয়েছে তা পুরনো, নতুন করে কোনও পরিসংখ্যান হয়নি। তবে প্রাণীদের প্রজাতি না কমলেও নির্দিষ্ট প্রজাতির পপুলেশন বেড়েছে বলে আমার জানা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর এসংক্রান্ত মনিটরিং ও তদারকি ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। সার্বিক ভাবে নতুন এ প্রকল্প সফল করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে এর সাথে সম্পৃক্ত করা জরুরি। ’
আমাদের প্রাণিবৈচিত্র্য: বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। সর্বশেষ হিসেবমতে, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এখানে ৮৮০ জন মানুষের বসবাস। অবকাঠামো, শিল্পকারখানা ইত্যাদি নির্মাণে বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে প্রাণিকূলের আবাসস্থল। প্রাণিবিজ্ঞানীদের হিসেবমতে, বাংলাদেশে ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির স্থলচর সরীসৃপ, ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির দেশীয় পাখি, ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি, ১১০ প্রজাতির স্থলচর স্তন্যপায়ী ও ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। তবে সময়ের বিবর্তনে এ পরিসংখ্যান দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমছে, অনেক প্রজাতি নাম লিখিয়েছে বিলুপ্তির তালিকায়-এমন অভিমত প্রাণিবিজ্ঞানীদের।
বাংলাদেশ সময় ১২১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১২