ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

নির্জন গ্রামে ‘কয়লার চুলা’, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২২
নির্জন গ্রামে ‘কয়লার চুলা’, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

সাভার (ঢাকা): বছর খানেক আগেও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির কারখানায় ভরেছিলো সাভার ও ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন নির্জন ও বনাঞ্চল জায়গা। বিভিন্ন সময় উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর অভিযান পরিচালনা করায় বন্ধ হয়েছে বেশিরভাগ অবৈধ সিসা কারখানা।

এখন দুই উপজেলায় সচারাচর দেখা না গেলেও নতুন করে পরিবেশের জীব ও বৈচিত্র্য নষ্টে মেতেছে কাঠ পুড়িয়ে তৈরি কয়লার চুলা।

সবুজে ঘেরা ধামরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল বালিয়া ইউনিয়নের টেটাইল গ্রামে দু’টি ও দক্ষিণ গাঁওতারা গ্রামে একটি চুলাতে (চুল্লি) কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কয়লা। কয়লা তৈরির সময় অবৈধ চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। মানুষের শ্বাসকষ্টও হচ্ছে।

এসব চুলা এক জায়গায় ৫টি করে চুল্লি রয়েছে। সেই চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়। কাঠ পোড়ানোর সময় নির্গত হয় প্রচুর কালো ধোঁয়া। কয়লা তৈরির এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও জৈববৈচিত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় প্রভাবশালী বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় অবাধে কোনো বাধা ছাড়ায় পরিবেশ দূষণ করে ব্যবসা করে যাচ্ছেন টেটাইল গ্রামের চুল্লি দু'টির মালিক নাহিদ রানা ও মো. ইমরান। নাহিদ আওয়ামী লীগের পদপ্রার্থী ও ইমরানের স্ত্রী ওই এলাকার সংরক্ষিত সাধারণ মহিলা সদস্য। অপরদিকে দক্ষিণ গাঁওতারা এলাকার চুল্লির মালিক নুরুল ইসলাম।

রোববার (৩০ জানুয়ারি) সরেজমিনে বালিয়া ইউনিয়নের টেটাইল গ্রামে ও দক্ষিণ গাঁওতারা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বংশী নদী ঘেঁষা নির্জন স্থানে নদীর একপাশে দু’টি ও অপর পাশে একটি চুল্লি। চুল্লির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে কাঠ সাজিয়ে একটি মুখ খোলা রেখে অন্য মুখগুলো মাটি ও ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খোলা মুখ দিয়ে আগুন দেওয়া হয় চুল্লিতে। আগুন দেওয়া শেষ হলে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

চুল্লিতে কর্মরত শ্রমিকদের থেকে জানা গেছে, প্রায় ৫ থেকে ৬ দিন কাঠ পোড়ানোর পর চুলা থেকে কয়লা বের করা হয়। এসময় প্রতিটি চুল্লি থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কয়লা পাওয়া যায়। ১৫ টি চুল্লি থেকে মাসে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা আয় হয়। প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। পরে এই কয়লা শীতল করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে ইটভাটায় বেশি দেওয়া হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঠ সংগ্রহ করে ওই চুল্লি বসিয়ে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যারা পোড়াচ্ছেন তারাও ক্ষমতাশালী লোক। এসব চুল্লি থেকে বের হওয়া ধোঁয়ায় আশপাশ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে এই ব্যবসা করা হচ্ছে।

টেটাইল গ্রামের চুল্লিগুলোর পাশেই বাড়ি আব্দুল মালেকের।

তিনি বলেন, চুল্লিতে কাঠ পোড়ানোয় সৃষ্টি হচ্ছে ধোঁয়ার। রাতে তো ছেলে মেয়েরা পরতেই বসতে পারে না। টিনের ঘর চারদিক থেকে ধোঁয়া আসে। চোখে জ্বালাপোড়া করে। গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। অনেকেই অসুস্থ হয়েছে। আর এই গাছগুলো আমাদের এলাকার কিছু মানুষের থেকে কিনে এনে টুকরো করে পুড়ায়।

এদিকে চুল্লিগুলোর মালিকরা বলছেন তাদের কোনো বৈধ কাগজ পত্র নেই। এসব বিষয়ে কোনো অনুমতিরও প্রয়োজন হয় না।

টেটাইল গ্রামের নাহিদ রানা বলেন, ক্ষতি তো একটু হবেই। অবৈধ ব্যবসার কোন অনুমতি হয় না। নির্জন জায়গা হলেই হয়। প্রশাসন যদি মনে করে ভাঙতে হবে তবে ভেঙ্গে ফেলবে।

দক্ষিণ গাঁওতারা গ্রামে চুল্লির মালিক নুরুল ইসলাম বলেন, লিখিত কোন অনুমতি নেই। অনুমতি সবারই মুখে মুখে আছে। পরিবেশের ক্ষতি তো একটু হবেই।

বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, এটার বিরুদ্ধে ওই গ্রামের লোকজনকে আইডিয়া দিছি। তারা এসবের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরও নিয়েছেন। ওরা যারা (চুল্লির মালিক) কাজ করতেছে ওরা আমাদেরই লোক। আমাদেরই কর্মী। এই জন্য অন্যদের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করা যায় কিনা দেখা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে ধামরাই পরিবেশ আন্দোলনের আহ্বায়ক সিয়াম সারোয়ার জামিল বলেন, চুল্লির মালিকরা সব সময় নির্জন জায়গা খুঁজে নেয়। যেখানে কেউ যাবে না কেউ ধরতেও পারবে না। এসব কয়লা কারখানা পরিবেশের জন্যে হুমকিস্বরূপ। একেধারে কয়লার জোগান দিতে গিয়ে তারা যেভাবে গাছ কাটছে করছে সেভাবে সেই চুলা থেকে সারা দিন ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের চাষাবাদে এটার প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি।

ধামরাই উপজেলা বন কর্মকর্তা মোতালেব আল মামুন বলেন, দুই বছর আগে আমরা এসব চুল্লি ভেঙে দিয়েছিলাম। পরে আমার বদলি হওয়ায় সেখান থেকে চলে আসি। তবে সম্প্রতি আমি আবার এখানে জয়েন করেছি। ইউএনওকে বিষয়টি জানিয়েছি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এগুলো ভেঙ্গে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ধামরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২২
এসএফ/এনএইচআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।