শাবিপ্রবি (সিলেট): সামুদ্রিক শৈবাল বা ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা) নিয়ে গবেষণা করে ৫ ধরণের প্রভাবক পেয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ড. সুব্রত সরকার। প্রভাবকগুলো সামুদ্রিক শৈবালকে বিভিন্ন দিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে।
সোমবার (১৪ নভেম্বর) সকালে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য তুলে ধরেন এ তরুণ গবেষক।
তিনি জানান, গবেষণায় ৫টি প্রভাবক পেয়েছেন তিনি। প্রথমটি ‘পুষ্টি উপাদান’, দ্বিতীয়টি ‘টার্বিডিটি বা পলি’ তৃতীয়টি ‘লবনাক্ততা’ চতুর্থটি ‘পানির তাপমাত্রা’ সর্বশেষ প্রভাবকটি ‘খাদক’। প্রথম প্রভাবকে ‘সিলিকেট, নাইট্রেট, ফসফেট’ রয়েছে। আমরা যেমন ভাত খাই ক্ষুধা মেটানোর জন্য, তেমনি শৈবালের ক্ষেত্রে এগুলো সে ভূমিকা পালন করছে, শৈবাল সেগুলো খেয়ে বেড়ে উঠে।
দ্বিতীয় প্রভাবকটি পানিতে বেশি বাড়লে অর্থাৎ পানির উপর স্তর পলি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে গেলে সূর্যের আলো উদ্ভিদকণার কাছে পৌঁছাতে পারে না। ফলে খাদ্য উৎপাদন বা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে শৈবাল কমে যেতে পারে। তৃতীয় প্রভাবকে রয়েছে ‘লবনাক্ততা’ এবং চতুর্থটি ‘পানির তাপমাত্রা’। এ দুটির মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি শৈবালের অস্তিত্বের জন্য হুমকিসরূপ। সর্বশেষটি খাদক, শৈবাল এটাকে খায়। আর প্রধান খাদক হচ্ছে মাছ। এর মধ্যে শৈবাল ও মাছের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রয়োজন।
সমুদ্রে এ শৈবালের নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশের কোনো উপাদান এটাকে প্রভাবিত করছে? তা দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শৈবালের নমুনা পরীক্ষা করেন এ গবেষক। এরমধ্যে পটুয়াখালী, ভোলা, সুন্দরবন, রাজশাহী, নোয়াখালীসহ উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে নমুনা ও পানি সংগ্রহ করেন। পানিতে থাকা ফ্যাক্টরগুলো উদ্ভিদকণাকে কীভাবে প্রভাবিত করে সে দিকটিও গবেষণায় উঠে আসে।
পানিতে থাকা পুষ্টি উপাদানগুলো বেশিরভাগ সুন্দরবন অঞ্চলে দেখা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুন্দরবনের গাছগুলো থেকে প্রতিনিয়তই পাতা ঝরছে, সেগুলো জোয়ারের পানির মাধ্যমে মূল পানিতে মিশে পঁচে যায়। একপর্যায়ে তা পানিতে পুষ্টি উপাদান সৃষ্টি করে। নদীর মোহনাগুলোতে এগুলো বেশি থাকে। তাই উদ্ভিদকণা সেখানে বেশি হয়, সেখানে মাছসহ বিভিন্ন জলজদের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।
গবেষণায় উঠে আসে, নদীর মধ্য দিয়ে সমতল বা পাহাড় থেকে মোহনা বা সমুদ্রে নির্গত যে পদার্থগুলো আসে, নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে সেগুলোর উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। ফলে উপকূল এলাকা ও মোহনায় লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে তা বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারা বনগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অতিরিক্ত লবনাক্ততা সহ্য করতে পারে। এখন সারাদিন যদি তা লবণ পানি দিয়ে ঢাকা থাকে তখন তা ক্ষতিকর হয়ে দাড়ায়। এর প্রভাব উপকূলীয় কৃষি জমিতেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তনে সঙ্গে মেরু অঞ্চলে বরফ গলা শুরু হয়েছে। এতে সমুদ্রে পানির স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, এক্ষেত্রে শৈবাল বা ফাইটোপ্লাংকটন কি ভূমিকা রাখতে পারে? সে বিষয়টিও ছিল বলে জানান তিনি।
সুব্রত সরকার বলেন, পৃথিবীর চারভাগের মধ্যে তিনভাগই সমুদ্র। এখন শৈবাল বা ফাইটোপ্লাংকটনও উদ্ভিদ। এটি সমুদ্রে বেড়ে ওঠে। এরাও কার্বন-ডাই অক্সাইড ও সালেকসংশ্লেষন হয়। শৈবালেরা কার্বন ডাই অক্সাইড নেওয়ায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বা উষ্ণায়ন লাঘবে ‘বাফার বা সেইফটি শিল্ড’ হিসেবে কাজ করছে।
শৈবাল বা উদ্ভিদকণা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কি ভূমিকা রাখছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমির অনেকগুলো উপাদান আছে। এরমধ্যে রয়েছে মাছ, সামুদ্রিক ঝিনুকসহ অন্যান্য উপাদান। বিদেশে এদের প্রচুর চাহিদা। আমাদের অর্থনৈতির জন্য এসব উপাদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশ।
এ গবেষক বলেন, প্রত্যেকটি জিনিসের একটি অপটিমাম শর্ত আছে। ব্লু-ইকোনমির উপাদানগুলোর প্রধান উপাদান হল মাছ। যদি আমরা মাছ চাষ করতে চাই, তাহলে আমাদের দেখতে হবে পানির গুণাগুণ, খাবার এবং পুষ্টিগুণ ইত্যাদি। তখনই সেখানে মাছ চাষ করা যাবে। তাই ব্লু-ইকোনমির ক্ষেত্রে এবং বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে বিবেচনায় শৈবাল বা ফাইটোপ্লাংকটন অন্যতম ভূমিকা রাখছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সামদ্রিক শৈবালের প্রভাবকসমূহ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ সম্প্রতি নেদারল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশনোগ্রাফির গবেষণা জার্নাল ‘জার্নাল অব সি রিসার্চ এলসিভিআর’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এ গবেষণাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্টোরের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। এছাড়া গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছরের মে মাসে তিনি ভিসি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২২
জেডএ