একটি সত্য ঘটনা দিয়ে কলম ধরব। একবার নিখোঁজ এক লোককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন প্রতিটি মৃতদেহের ময়নাতদন্তকালে আমরা ফরেনসিক প্যাথলজিস্টরা মূখ মন্ডল ও দাঁতের ছবি, শিরিশ কাগজে তিন ফোঁটা রক্ত আর পাঁচ আংগুলের ছাপ রাখতে ভুলেও আর ভুল করি না। ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ায় এখন সেরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে দেশে ফরেনসিক প্যাথলজিস্টরা এখন প্রস্তুত থাকেন। বাংলাদেশে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনো ইতিহাস আমাদের নেই। তাই তো বিএনপিনেতা জামাল উদ্দিনের ছেলে ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া প্রসংগে বলেছিলেন, ‘‘সে সময় সরকার (বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকার) যদি সঠিক ব্যবস্থা নিত তাহলে আজ এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। ”
সারাবিশ্বে ফরেনসিক সায়েন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার ছোঁয়া একেবারেই লাগেনি। চূড়ান্তভাবে অবহেলিত এই বিষয়ে লাইব্রেরিতে নেই কোনো জার্নাল! নেই কোনো উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা!! অথচ মান্ধাতা আমলের প্রথা মেনে তদন্ত প্রতিবেদনের মানও মান্ধাতা আমলকে আঁকড়ে ধরে আছে। ফরেনসিক মেডিসিনে পরীক্ষানির্ভর এমসিপিএস আর ডিপ্লোমা খোলা হলেও শিক্ষক কিন্তু মেডিকেল কলেজে পাঠদানকারী শিক্ষকেরাই! ফলে এমসিপিএস আর ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞগণের জ্ঞান যে বিশেষজ্ঞ মাত্রায় নেই তা সহজেই বোধগম্য। এক যুগ আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে থাকার সময়ে চেষ্টা করেছিলাম প্রতিবেদনের ছাপানো ফরমকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার। দুর্ভাগ্য, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ঠেলাঠেলিতে আমার ‘‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও’’ অবস্থা। বড় বড় চেয়ারে বসে থেকেও কেউ সিদ্ধান্ত দিতে চান না। তাকিয়ে থাকেন মন্ত্রী, সচিবের দিকে। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের আধুনিকায়নে আমার চেষ্টা সে সময় তদবিরের অভাবে থেমে গিয়েছিল।
আমি দেশে গেলে রাজধানী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ঘুরে বেড়াই। সবাই যেন এই বিষয়ে যোগ দিয়ে হতাশ। আর হতাশার কারণে তাদের সকল আগ্রহই যেন লোপ পেয়েছে। রাজনৈতিক দলের বিবেচনায় পদোন্নতির কারণে যোগ্য ফরেনসিক প্যাথলজিস্টের সংখ্যা এখন শূন্য’র কাছাকাছি। মনে পড়ে, আমার কর্মকালে ফরেনসিক মেডিসিনে ডিপ্লোমা করা একজনকে রাজনৈতিক কারণে অজপাড়াগাঁয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হলে স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে অনুরোধ করে আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিন মেডিসিন বিভাগে নিয়ে এসেছিলাম। সেসময় তার এই পদায়ন নিয়ে কত কটুক্তিই না আমাকে শুনতে-সইতে হয়েছে!
যে কথা বলছিলাম, বাংলাদেশের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেই পাঠাগার, পরীক্ষাগার এবং মর্গ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের নতুন মর্গে পানি আর ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই! নেই ময়নাতদন্তের টেবিল আর শবব্যবচ্ছেদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। যে ডিএনএ ল্যাব আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নিয়ে এসেছিলাম তা আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিএনএ ল্যাব এর যদি এতই প্রয়োজন হল, তাহলে তারা নিজেরা কেন তা স্থাপন করলেন না। তাহলে কি ডিএনএ পরীক্ষায় চেক অ্যান্ড ব্যালেÏস রাখা যেত না!
আমি এখন মালয়েশিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি। এখানে চুতুর্থ বর্ষের মেডিকেল ছাত্রদের ফরেনসিক মেডিসিন পড়ানো হয়। বছর শেষে ছাত্রদের যখন তাদের ভবিষৎ পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করা হয় তখন নিদেনপক্ষে ৮-১০জন ভবিষ্যতে ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। একই প্রশ্ন বাংলাদেশের মেডিকেল ছাত্রদের করা হলে উত্তর কি হবে তা বলাই বাহুল্য। হবু ডাক্তারদের এই অনাগ্রহ দেখলে বোঝা যায়, ফরেনসিক মেডিসিনের ভবিষৎ কোন পথে এগুচ্ছে?
পেশাগত কারণে বিভিন্ন ফরেনসিক কনফারেন্সে আমাকে যেতে হয়। হাজারো ফরেনসিক প্যাথলজিস্টের মিলনমেলায় বাংলাদেশি ফরেনসিক প্যাথলজিস্টদের দেখা পেতে ইলেক্ট্রনিক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ের মত ফরেনসিক মেডিসিনে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই; আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা? সে তো চাঁদের চেয়েও দূরত্বে।
সাগর-রুনীর প্রথম ময়নাতদন্ত যে সম্পূর্ণ ছিল না তা গলা ফাটিয়ে বললেও শোনার কেউ ছিল না।
দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের আদেশের পর সবাই যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। মাঘ মাসের কাঁথা জ্যৈষ্ঠ মাসে গায়ে দিলে কোনো লাভ আছে? কেউ কি ভেবেছেন বাংলাদেশের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের লোকবলে অধ্যাপক অথবা সহযোগী অধ্যাপকের সংখ্যা কত? তাদের মধ্যে যোগ্য ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট কতজন? কর্তাব্যক্তিদের সবিনয়ে জানাতে চাই, শূন্যকে শূন্য দিয়ে যত অংকই কষা হোক না কেন ফলাফল কিন্তু সেই শূন্যই থেকে যাবে।
সঠিক শনাক্তকরণের অভাবে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় আজ তারা বেপোরোয়া। চিকিৎসাশাস্ত্রের যে বিষয়টি অপরাধী শনাক্ত করণে ভুমিকা রাখবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ফরেনসিক বিষয়টি বাংলাদেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুপস্থিত।
যেহেতু ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়টি ফরেনসিক সায়েন্সের একটি উপশাখা, যেহেতু অপরাধী শনাক্তকরণে ফরেনসিক সায়েন্সের অন্যসব উপশাখা সরাসরি জড়িত এবং যেহেতু ধর্ষণ, হত্যা, গুমের মত সমস্যা কেবল ফরেনসিক সায়েন্সের মাধ্যমেই সমাধানযোগ্য, সেহেতু দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেডিকেল কলেজসমূহের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অতি সত্বর ফরেনসিক সায়েন্স ইনস্টিটিউট স্থাপনের অনুরোধ জানাচ্ছি। ফরেনসিক সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধীনে জরুরি ভিত্তিতে নিম্নবর্ণিত বিভাগসমূহের জন্য মঞ্জুরি বরাদ্দ করা প্রয়োজন:
১। ফরেনসিক প্যাথলজি
২। ফরেনসিক ব্যালিস্টিক
৩। ফরেনসিক টক্সিকোলজি
৪। ফরেনসিক এন্টোমোলজি
৫। ফরেনসিক ইঞ্জিনিয়ারিং
৬। ফরেনসিক অডন্টোলজি
৭। ফরেনসিক পেডিয়েট্রি/ড্যাক্টাইলোগ্রাফি
৮। ফরেনসিক সেরোলজি
৯। ফরেনসিক কেমিস্ট্রি
১০। ডিজিটাল এবং সেল ফোন ফরেনসিক
এইসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি মেডিকোলিগাল সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হলে বিচার বিভাগ ও দেশ উপকৃত হবে। একথা সত্য যে ফরেনসিক বিজ্ঞানীর অপ্রতুলতায় ইনস্টিটিউট স্থাপনে প্রতিকূলতা রয়েছে। এই প্রতিকূলতা কাটাতে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠনের সহায়তায় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে। সেই প্রকল্পের অধীনে কর্মরত বিদেশি বিশেষজ্ঞগণ স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ প্রদানের শর্তে নিয়োজিত হলে স্থানীয় বিশেষজ্ঞগণ সেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারবেন এবং পরবর্তী সময়ে সেই শাখার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবেন।
লেখক: অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক কনসালট্যান্ট
ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা
৪০৪৫০ শাহ আলম, মালয়েশিয়া।
ইমেইল : [email protected]
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]