যারা চাকরি করেন তাদের কাছে অফিস মানেই দায়িত্ব। কর্মস্থলে প্রতিদিন একগাদা দায়িত্ব পালন করতে হয়।
সত্যিই কথা হলো, এমন মানুষ আছে। আর্থার উইন্সটন নামে এক আমেরিকান নাগরিক দীর্ঘ ৭৬ বছর টানা চাকরি করেছেন (তথ্যগত নির্ভুলতার বিচারে কয়েক বছর কমবেশি হতে পারে)। এই সময়ে তিনি মাত্র একদিন ছুটি নিয়েছিলেন!
উইন্সটনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায় ১৯০৬ সালের ২২ মার্চ। সেই শহরেই মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি কটন পিকার (বাগান থেকে তুলা সংগ্রহকারী বা তুলা কাড়ানি) হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৯১৮ সালে তার পরিবার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে চলে আসে। ক্যালিফোর্নিয়ার জেফারসন হাই স্কুল থেকে ১৯২২ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। এর কয়েক বছর পর লস অ্যাঞ্জেল্স রেলওয়েতে চাকরি শুরু করেন। সেখানে নিয়ম ছিল- কালোদের কৃষ্ণাঙ্গদের গাড়ির চালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে না। এই বর্ণবাদী নিয়মের প্রতিবাদে কৃষ্ণাঙ্গ উইন্সটন চাকরি ছেড়ে দেন।
তবে, কোনো কারণে কয়েকবছর পর তিনি ১৯৩৪ সালে ওই চাকরিতে ফিরে আসেন। ১৯৪৫ সালের পর লস অ্যাঞ্জেল্স রেলওয়ের নাম পাল্টে হয় ‘লস অ্যাঞ্জেল্স ট্রানজিট লাইনস’। কয়েকবছর পর আবার ১৯৫৮ সালে এই নামও বদলে যায়। এবার নামকরণ হয় ‘লস অ্যাঞ্জেলস মেট্রোপলিটন ট্রানজিট অথরিটি”। এভাবেই সবকিছুর সাক্ষী হতে থাকেন উইন্সটন। সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে এর নাম হয় “মেট্রো”। সবাই লস অ্যাঞ্জেল্স রেলওয়েকে এখন মেট্রো নামেই চেনেন।
১৯৩৪ সাল থেকে শুরু করে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত তিনি একদিনও অফিস থেকে ছুটি নেননি। ২২ মার্চ তার স্ত্রী মারা যাওয়ায় সেদিন অফিস আসতে পারেননি। শোকের এই দিনটি ছিল তার শততম জন্মদিনও।
তার এই শৃঙ্খলিত (!) চাকরি জীবনের মূল্যায়ন স্বরূপ ১৯৯৬ সালে তৎকালিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাকে ‘এমপ্লোয়ি অব দ্য সেঞ্চুরি’ পদে ভূষিত করেন। মাত্রাতিরিক্ত দায়িত্বপূর্ণ মনোভাবের কারণে তিনি সাধারণ্যে নতুনভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার অফিসের ঊর্দ্ধতনরা জানান, উইন্সটন কখনও অফিসে দেরি করে আসেননি। স্ত্রীর মৃত্যুদিন ছাড়া তিনি একদিনও ছুটি নেননি। সবসময় নিয়ম মেনে কাজ করেছেন। প্রতিটি কাজ তার কাছে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম।
তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপন করে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি ও আমার স্ত্রী খেতাম ও ঘুমাতাম। ধনী হওয়ার কোনো চেষ্টা কিংবা চিন্তা আমাদের দু’জনের ছিল না। ”
তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পরই উইন্সটন ভেঙে পড়েন। একা একা জীবন তার কাছে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সঙ্গী চলে যাওয়ার মাত্র এক মাস না যেতেই ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল ঘুমের মধ্যে চলে যান না ফেরার জগতে।
তার মৃত্যুতে লস অ্যাসঞ্জেলস মেট্রোর সব কর্মকর্তা-কর্মচারী গভীর শোক প্রকাশ করেন।
তার চাকরি জীবন প্রতিটি তরুণের কাছে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
আর্থারের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, “আপনি এতোদিন বেঁচে আছেন কিভাবে?” উত্তরে আর্থার উইন্সটন বলেছিলেন, “আমি সিগারেট খাই না। কখনও মদও খাইনি। তাই আমি ভালো আছি। ”
আর্থার উইন্সটন খুব সাধারণ গোছের কর্মচারী ছিলেন। অথচ একমাত্র নিয়মিত নিজ দায়িত্ব পালন করেই হয়ে গেলেন অসাধারণ। সপ্তাহ-মাস বা বছরে ছুটি ছাড়া বিশ্রামহীন কাজ করে যাওয়া অধিকাংশ মানুষের কাছেই বিরক্তিকর আর অসম্ভব মনে হলেও পৃথিবীতে আর্থারের মত মানুষগুলো খুব নিরবেই নিজের কাজ করে যান। আর্থার উইন্সটনের কর্মজীবন যে যেভাবেই দেখুন, দায়ত্ব পালনের বিচারে এক কথায় বলা যায় অসাধারণ আর অদ্বিতীয়। অনেক ক্ষেত্রেই আর্থার উইন্সটনের মত মানুষগুলো অনুপ্রেরেণাদায়ক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
আর্থার উইন্সটনের অসাধারণ কর্মনিষ্ঠা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন কেউ হয়তো তার চেয়ে বেশিদিন ছুটিহীন থেকে নতুন কর্মস্পৃহার ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড গড়বেন। আপাতত সেই প্রতীক্ষায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১২
সম্পাদনা: আহসান কবীর, আউটপুট এডিটর