প্রতিটি মানুষ চায় ঈদের দিনটি অন্তত প্রিয় মানুষদের সাথে কাটাতে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। অথচ দায়িত্বের খাতিরে অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়না পরিবারের পাশে থেকে আনন্দ করার।
১৯৯৮ সাল, চাকরি সূত্রে আমি তখন সেনাবাহিনী হতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিডিআর(বর্তমানে বিজিবি)এর একটি দুর্গম ক্যাম্প মাইন্দারছরাতে কাম্প কমান্ডার হিসেবে অবস্থান করছিলাম। এখানে উল্লেখ্য, ঠিক ঐ সময়ে পার্বত্য এলাকায় পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র মিযানমারের আরাকান প্রদেশের নাসাকা বাহিনীর অপঃতৎপরতা দেখা দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন অপারেশনে ব্যস্ত থাকতে হতো। রমজান মাসেও বেশ কয়েকটি অভিযানে আমাকে নেতৃত্ব দিতে হয়।
যাইহোক উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে রমজানের ঈদে যে ছুটি পাওয়া যাবে না সেটা ক্যাম্পের সবাই আগে থেকেই অনুধাবন করতে পারছিলাম। তবে ঈদের দিনটি যাতে অপারেশনে বাইরে কাটাতে না হয় মনে মনে সবাই সেই দোয়াটাই করছিলাম। ক্যাম্পে ঐ সময়ে আমিসহ মোট ৩২ জন ছিলাম।
আমাদের খাদ্য-সামগ্রী মাসে দু’বার হেলিকপ্টার যোগে কাপ্তাই হতে পাঠানো হতো। সেবার ঈদের দু’দিন আগে হেলিকপ্টার আসার দিন নির্ধারিত ছিল আর আমাদেরও অপারেশন শেষে ২৯ রোজার দিনই ক্যাম্পে ফেরত আসার কথা। ঈদের দু’দিন আগে অর্থাৎ ২৯ রোজার দিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় হেলিকপ্টার আসতে পারেনি আর কপাল খারাপ থাকায় শাওয়ালের চাঁদও ঐদিন দেখা দেয়; ওয়ারলেস সেটে খবর আসে পরের দিন ঈদ। সন্ধ্যায় অপারেশন শেষে ক্যাম্পে ফিরে আসার পর যখন জানলাম হেলিকপ্টার আসতে পারেনি আবার পরের দিন ঈদ; তখন যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরার মত অবস্থা।
আমাদের ক্যাম্প হতে সবচেয়ে নিকটবর্তী বাজার ছিল ‘ফারুয়া বাজার’ যেখানে হাতে গোনা কিছু জিনিস যদিও বা পাওয়া যেত কিন্তু যেতে আসতে ১০ -১২ ঘণ্টা সময় লাগতো। সিদ্ধান্ত নিলাম খুব ভোরে স্থানীয় পোর্টার (বিভিন্ন সময় আমাদের মালামাল বহন করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি) কে ‘ফারুয়া বাজার’ এ পাঠাবো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ক্যাম্পের ‘ইতিহাস’ বইটা খুলে দেখছি কোথাও ঈদ সংক্রান্ত কোনো লেখা আছে কিনা। বেশকিছু সময় ঘাটাঘাটির পর যা পেলাম তা দেখে তো আঁতকে ওঠার মত অবস্থা। একটি ঘটনার বর্ণনা পেলাম: বেশ কয়েক বছর আগের কথা, তখন শান্তি বাহিনীর শক্ত অবস্থান ছিল পার্বত্য এলাকা। এক ঈদের দিন সকালে নামাজের আগে ক্যাম্পের নিচের ছরা (ঝরণা) হতে গোসল করে ফেরার সময়ে শান্তিবাহিনীর বার্স্ট (ব্রাশ) ফায়ারে ক্যাম্পের মোট ১৯ জন সদস্য শহীদ হন। লেখাটা পড়ে ঐ রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।
সকালে গোসল সেরে সবাই মিলে ঈদের নামাজ পরার পর লক্ষ্য করলাম, প্রাত্যহিক রুটি-সবজি দিয়ে নাস্তা পর্বে যেন সবার মনের ভেতর সেমাই-পায়েস না খাওয়ার চাপা কষ্ট ফুটে উঠছে; সেই সাথে দুপুরেও নিরামিষ আহারের ‘শংকা’!
আমি তখন অধীনস্থ সবাইকে ডেকে গল্প করার ফাঁকে একসময় শোনালাম গত রাতের পড়া সেই বিভীষিকাময় মাইন্দারছরা ক্যাম্পের ঈদের দিনের করুণ ইতিহাস। এ ঘটনা শোনার পর সবাই হতভম্ব হয়ে অনুধাবন করল ভয়ঙ্কর সেই ঈদের যন্ত্রণা আর মুহূর্তেই উবে গেল আজকের দিনের না পাওয়ার সকল বেদনা। অবশিষ্ট দিনটুকু আমরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন খেলাধুলা আর গল্পগুজবে বেশ ভালোভাবেই কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য পোর্টার মামার (আদর করে মামা ডাকা হতো) বদৌলতে রাতের খাবারটা একেবারে মন্দ ছিল না।
মানুষের জীবনে শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এই ঈদের দিনটি তাই সাধ ও সাধ্যের ভিতর যতটুকু সম্ভব আনন্দময় করে তোলার দিকেই সকলের মনোযোগ থাকুক এই কামনায় করি। সবাইকে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ‘ঈদ মোবারক!’
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৯ ঘণ্টা, ২৫ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]