ঢাকা, বুধবার, ৪ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ জুন ২০২৫, ২১ জিলহজ ১৪৪৬

ফিচার

বিদায় নিল আর্মস্ট্রং

রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৫৭, আগস্ট ২৬, ২০১২
বিদায় নিল আর্মস্ট্রং

ঢাকা: ১৯৬৯ সালে নিল আর্মস্ট্রং যখন প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের বুকে নিজের পদচিহ্ন একে দিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তেই তিনি পরিণত হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ হিসেবে।

পরবর্তীতে সে মাহেন্দ্রক্ষণের অনুভুতি নিয়ে যখন তাকে প্রশ্ন করা হলো তিনি উত্তর দেন সাদামাটাভাবে।

তার জবানিতে, “খুবই, খুবই, সাধারণ অনুভূতি। ”

অবশ্য তিনি তার এ কৃতিত্বের মূল্যায়ন সম্পর্কে নিজেই প্রশ্ন করা শুরু করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন মানুষের এ মহান অর্জনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যা তাকে হয়তো কিছুটা বীতশ্রদ্ধও করে। এ কারণেই তিনি পরবর্তীতে বেছে নেন কিছুটা নিভৃতচারীর জীবন।

তিনি দেখেছেন কিভাবে মহাবিশ্ব আবিষ্কারের অভিযান ক্রমাগতভাবে বৈশ্বিক রাজনীতি এবং সুপার পাওয়ারগুলোর একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার ইঁদুর দৌড়ের মাঝে তলিয়ে যাচ্ছে। এসব লক্ষ করে অনেকটা বিরক্ত হয়েই তিনি এক সময় এ সব থেকে সরে যান অনেকটা দূরে।

নিল আডেন আর্মস্ট্রং যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে জন্ম নেন ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। বাবার কর্মস্থল  বদলির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে তাকে ঘুরতে হয়েছে একস্থান থেকে আরেক স্থানে।

বয়স যখন মাত্র ছয়, তখন আর্মস্ট্রং বাবার সঙ্গে প্রথম বিমানে আরোহন করেন। শূন্যে ওড়ার সেই সূচনায় জেগে ওঠা উড্ডয়ন-তৃষ্ণা সারাজীবন তাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে আকাশের সীমা ছাড়ানোর বাসনায়।

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই গাড়ি চালানো শেখার আগে বিমান চালানো শিখে ফেলেন তিনি। চাঁদে প্রথম মানুষ হিসেবে পা রেখে খ্যাতি লাভের অনেক আগেই অবশ্য কোরিয়া যুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর দুধর্ষ এক জঙ্গি বিমান চালক হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
 
উড্ডয়নে চূড়ান্ত দক্ষতাই নাসার মহাকাশ অভিযাত্রা প্রকল্পের টেস্ট পাইলট হিসেবে নিলের মনোনীত হওয়ার পথে বড় ভূমিকা পালন করে।

মানুষের তরফে একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ...

তিনিই নাসার প্রথম দিককার কয়েকজন কর্মীর অন্যতম যাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাকে বলা হতো ‘সারভাইভাল ট্রেনিং’।

১৯৬২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি অঙ্গীকার করেন, দশকের শেষ নাগাদই তিনি চাঁদে মানুষ পাঠাবেন, তা যেভাবেই হোক না কেন।

ইতিমধ্যেই রাশিয়া মহাকাশে মানুষ পাঠিয়ে (ইউরি গ্যাগারিন) আমেরিকানদের টেক্কা দিয়েছে। পরিস্থিতি এমনিতেই মার্কিনীদের তাতিয়ে দিয়েছিলো, কেনেডির ঘোষণা সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিল। মহাকাশ জয়ে মার্কিনি উৎসাহ উন্মাদনায় রূপ নিল।

কেনেডির অঙ্গীকার পুরো করার জন্য প্রত্যেক মার্কিনীই যে কোনো কিছু করতে রাজি ছিলো যেনো এ সময়। ফলে নাসার অ্যাপোলো কর্মসূচিতে অর্থসহ অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রাচুর্যের কোনো অভাব হয়নি কখনোই।

এদিকে নিল আর্মস্ট্রং সফল পাইলট হিসেবে কোরিয়া যুদ্ধে কৃতিত্ব দেখানোর পাশাপাশি নাসার পূর্বাপর মিশনগুলোতেও তিনি স্বাক্ষর রাখেন অসাধারণ দক্ষতার। পূর্ববর্তী জেমিনি-৮ মিশনের পাইলট হিসেবে আর্মস্ট্রং তার ক্যাপসুলের বিভ্রান্ত গতিপথ সামাল দিয়ে নিজের ও তার সহ-পাইলটের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আকাশে যন্ত্রযান নিয়ে উড্ডয়নে এই সহজাত দক্ষতাই তাকে স্বাভাবিকভাবে অ্যাপোলো ১১’র নেতৃত্বে আসীন করে।

১৯৬৯ সালের মধ্যেই নাসা কেনেডির অঙ্গীকার পূরণের পথে প্রয়োজনী সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। প্রসঙ্গত, অ্যাপোলো-১১ চন্দ্রযানে যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিলো তার কম্পিউটিং দক্ষতা বর্তমানকালের একটি আধুনিক ল্যাপটপের থেকে হাজার গুন কম ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলো। বর্তমানের তুলনায় হাজার গুন পিছিয়ে থাকা প্রযুক্তির বলে আর্মস্ট্রং ও তার দুই সহযোগী বাজ অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স চন্দ্রাভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

সারা বিশ্বের মানুষের চোখই তখন সেঁটে ছিলো টেলিভিশনের পর্দায়। টেলিভিশনের সামনে বসেই তারা হতে চেয়েছিলেন চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদক্ষেপের প্রত্যক্ষদর্শী হতে। ২০ জুলাই মানুষের চন্দ্র অবতরণের প্রত্যেকটি মুহূর্ত সারাবিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের ১০০ কোটি চোখ টেলিভিশনের পর্দায় অবলোকন করে।

চন্দ্র পৃষ্ঠের বড় বড় পাথর এড়িয়ে আর্মস্ট্রং যখন চূড়ান্তভাবে তার মডিউলটিকে সুচারুরূপে অবতরণ করালেন তখন তার ক্যাপসুল যানটিতে আর ২০ সেকেন্ড চলার মত জ্বালানি অবশিষ্ট ছিলো।

সফল অবতরণের পর তিনি ক্যাপসুলের ভেতর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে মিশন কন্ট্রোল রুমে প্রথম বার্তা পাঠালেন, “ঈগল অবতরণ করেছে!”

এবং ক্যাপসুল থেকে চাঁদের মাটিতে প্রথম পদক্ষেপের পর তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো সেই বিখ্যাত বাণী, “একজন মানুষের জন্য একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানব সম্প্রদায়ের জন্য বিশাল অগ্রযাত্রা। ”

এরপর তিনি চন্দ্রপৃষ্ঠের সুমসাম চরাচরে পুঁতে দিলেন মার্কিন পতাকা। মাহেন্দ্র এ ক্ষণটিতে এসময় অ্যাপোলো ১১’র ক্রুদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।

পৃথিবীর মাটিতে ফিরে আসার পর অ্যাপোলোর ক্রুরা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয় সারা বিশ্বেই সম্মান ও মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম হন। বিশ্বের যেখানেই গেছেন সেখানেই তারা চলচ্চিত্র তারকাদের মত মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন (তবে প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, চাঁদের মাটিতে পা রাখার মার্কিনি এই অভিযানকে স্রেফ একটি কৌতুকবাজী বলেও অভিহিত করে থাকেন একটি পক্ষ। এ বাববদে তারা বেশ কিছু যুক্তিও উপস্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার বাইরে রাখা হলো)।

তবে তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনার প্রাথমিক পর্ব কেটে গেলে আর্মসট্রং তার এ অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে যে কোনো সুবিধা গ্রহণ বা লাভবান হওয়ার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেন।

আমেরিকানদের কাছে সত্যিকারের বীর হিসেবে বিবেচিত হওয়া এ ব্যক্তি পরবর্তীতে পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনেন। যাপন করতে থাকেন নিভৃতচারীর জীবন।

পরবর্তী জীবনে আর দশজন স্বাভাবিক আমেরিকানের মতই তিনি ওহাইওতে নিজের খামার বাড়িতেই বসবাস করতেন।   তবে মাঝের বেশ কিছুদিন তিনি সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিদ্যার ওপর শিক্ষকতা করেন।

কোনো ধরণের অটোগ্রাফ বা সাক্ষাতকার দিতে তার তীব্র অনীহা ছিলো সর্বজনবিদিত। যা হয়তো অনেক সময়ই তার ভক্তদের আশাহত  করতো। শুধু কালে ভদ্রেই কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতেন তিনি।

তিনি অবশ্য তার এ অবস্থান পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তার জবানিতেই উঠে আসে বিষয়টি, “একজন স্মরণীয় ব্যক্তি হিসেবে আজীবন বেঁচে থাকার ইচ্ছা কখনই আমি পোষণ করিনি। ”

এসময় তার সহকর্মী নভোচারীদের অনেকেই যখন খ্যাতির আতিশয্যে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হারিয়ে ফেলছিলেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতই সুখী ও শান্তির জীবন যাপন করতে সক্ষম হন।

অ্যাপোলো অভিযানে তার অন্যতম সহকর্মী বাজ অলড্রিন পরবর্তীতে খ্যাতির তোড়ে নেশায় আক্রান্ত হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

নিজেকে খ্যাতির বিড়ম্বনা থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেকটা নিভৃতচারীর জীবন যাপন করলেও নিল আর্মস্ট্রং তার চারপাশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম ছিলেন। ১৯৯৯ সালে চাঁদে মানুষের অবতরণের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তাকেসহ অ্যাপোলো অভিযানের অন্যান্য ক্রুদের ল্যাংলি পদক দেওয়া হয়। তাদের হাতে পদক তুলে দেন তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর।

সেদিন একদল ছাত্র তার সঙ্গে দেখা করেছিলো। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি দিয়েছিলেন তার আরেকটি অমর বাণী, “সুযোগ তোমার চারপাশেই আছে, কিন্তু তুমি তা কোনোদিনই কল্পনা করতে পারো না!”

যদিও ১৯৭২ সালের পর আর কেউই চাঁদের বুকে হাঁটেনি এবং বর্তমান বিবেচনায় সেখানে আবারও নামার চেয়ে মঙ্গল বা আরও দূরের কোনো লক্ষের দিকে যাত্রাই অধিক সম্ভাবনাময়। তবে ১৯৬৯ সালে সারা বিশ্বের যেসব মানুষ টেলিভিশনের সামনে রূপকথাকে নিজের চোখের সামনে বাস্তব হতে দেখেছেন তারা কখনই ভুলবেন না আর্মস্ট্রংকে।

তাদের চোখের সামনে ওহাইয়োর সেই লাজুক ব্যক্তি যে স্বপ্নের পরিধি উন্মোচন করে দিয়েছিলো, তা তারা কখনোই মুছে ফেলতে চাইবেন না। তারা কখনোই ভুলবেন না, নিল আর্মস্ট্রং কী করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সমগ্র মানব সম্প্রদায়ের সামনে কী বিশাল অর্জনের সম্ভাবনার দ্বার তিনি উন্মুক্ত করেছিলেন।

নিল আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে বাংলানিউজ পরিবার শোক জানাচ্ছে। তার তাকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।