নারায়ণগঞ্জ : বাংলানিউজের নিয়মিত পাঠক ফাইজুল ইসলাম। গত কয়েকদিন ধরেই ‘নীল চাঁদ’ বা ব্লু মুন এর সংবাদ দেখে শুক্রবার রাতে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বেশ উৎসাহ আর কৌতুহল নিয়েই হাজির হয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫নং ঘাট এলাকায় বিআইডব্লিউটিএ এর জেটিতে।
বেচারা ফাইজুল পড়ে যান চরম বেকায়দায়। কারণ তিনি তো বন্ধুদের বেশ জোর গলায় বলেছিল নীল চাঁদ দেখবে। যখন কিছুটা হইচই শুরু করলেন। তখনই খুঁজে পেলেন আয়োজকদের একজন পেশাদার বিজ্ঞান বক্তা আসিফকে। তখন জটলা পাকানো ফাইজুল ও তার বন্ধুদের আসিফ বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিলেন নীল চাঁদ এর মর্মকথা। তখনই একজন বলে উঠলো, বাংলানিউজেও একই কথা উল্লেখ ছিল।
দূরবীক্ষণের মাত্র চাঁদ দেখা শেষ করে একজন সেই বহুচর্চিত আক্ষেপ ফের করলেন, কই চাঁদ তো নীল দেখলাম না!
টেলিস্কোপের পাশে দাঁড়ানো স্বেচ্ছ্বাসেবক তরুণটির চটজলদি জবাব, আরে ভাই, নীল চাঁদ দেখতে হইলে গ্যালিলিওর চোখ লাগবো! এ কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
কথা হলো বিজ্ঞান বক্তা আসিফের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ ছিল তা অকল্পনীয়। বিশেষ করে প্রচুর শিশুরা এসেছিল চাঁদ দেখার জন্য। নারীদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মত। মেঘে চাঁদ কিছু সময়ের জন্য ঢেকে গেলেও মানুষের মধ্যে ছিল না বিরক্তি কিংবা উদ্দীপনার ঘাটতি। বিষয়গুলো আয়োজকদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি নারায়ণগঞ্জের এ আয়োজন নিয়ে বাংলানিউজের প্রচারণার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন।
মিডিয়ার খবর পেয়ে গোদনাইল এলাকা থেকে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে শহরের ৫নং ঘাট এলাকায় এসেছিল তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী শিশু তানহা। সে যখন রাত ৮টা ৫০ মিনিটে ৫নং ঘাট এলাকায় বিআইডব্লিউটিএ এর জেটির ঘাটে পৌঁছায় তখন হঠাৎ করেই মেঘের কালো আবরণে ঢাকা পড়ে যায় চাঁদ। মুহূর্তের মধ্যে তানহার এতক্ষণকার আনন্দ উদ্ভাসিত ছোট্ট মুখটিতে পড়ে হতাশার ছায়া।
কিন্তু নাছোড়বান্দা তানহা। যত রাতই হউক সে ‘নীল চাঁদ’ দেখবেই। রাত সাড়ে ১০টায় যখন মেঘের আড়াল থেকে চাঁদকে ফের একবার দেখা গেলে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লো তানহা। বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে দেখলো ‘নীল চাঁদ’ বা ‘ব্লু মুন’।
শুধু তানহা নয়, শুক্রবার রাতে দূর আকাশে উজ্জ্বল ‘নীল চাঁদ’ দেখেছে অসংখ্য মানুষ। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় কেউ যেন মিস করতে চায়নি এ দৃশ্য। এ কারণেই রাত ৮টার পর থেকে মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চললেও শেষ পর্যন্ত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আশপাশ এলাকা ছেড়ে যায়নি উৎসুক আর কৌতুহলী মানুষ। রাত ১২টা পর্যন্ত শত শত মানুষ অধীর অপেক্ষা আর দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছে অন্য ধরনের দুর্লভ আর ‘অভিজাত’ এই চাঁদকে (একইমাসে দ্বিতীয়বার দেখা দেওয়ার কারণে)।
সাধারণত, রাতের বেলায় বালুবাহী অনেক ট্রলার ও বলগেট ৫নং ঘাট এলাকাতেই অবস্থান করে। ওইসব নৌ যান থেকেও কয়েকজন এসেছিলেন এখানে। তাদের একজন লুৎফর বাংলানিউজকে জানালেন, নিয়মিত নৌ যানে থাকার কারণে চাঁদকে বেশ ভালোভাবেই দেখেন তিনি। তবে শুক্রবার রাতের চাঁদটি তার কাছে একটু অন্য ধরনের লেগেছে-- বলে জানালেন।
শুক্রবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ কারণে বিকেল থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলী থেকে শত শত মানুষ উৎসাহ আর কৌতুহল নিয়ে জড়ো হয়েছিল ৫নং ঘাট এলাকাতে।
পৌনে ৩ বছর পর শুক্রবার পূর্ণিমায় ‘নীল চাঁদ’ বা ‘ব্লু মুন’ দেখতে সন্ধ্যা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড়ে জমেছিল বিভিন্ন শ্রেণি পেশার শত শত মানুষের ভীড়। মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি থাকলেও অধীর আগ্রহে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অবস্থান শীতলক্ষার পাড়কে সারাক্ষণ রেখেছে উৎসবমুখর।
এ উপলক্ষ্যে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল শীতলক্ষ্যার পাড়। আয়োজক নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট ও বিজ্ঞান সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্ট এর লোকজন বিকেল থেকেই সাউন্ড সিসটেম, মঞ্চ তৈরি আর দূরবীক্ষণ যন্ত্র প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে অন্যবারের তুলনায় অনেক ভালোভাবেই নীল চাঁদ পর্যবেক্ষণ করা যাবে বলে ধারণা ছিলো আয়োজকদের। রাত সাড়ে ৭টায় চাঁদ দেখার শুরুতেই ছিল মানুষের ঢল। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নানা বয়সী শত শত মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে চাঁদ দেখতে। কারোই যেন ছিল না ক্লান্তি। মানুষের ঢল সামলাতে নিয়োজিত ডিসকাশন প্রজেক্ট আর সাংস্কৃতিক জোটের স্বোচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সঙ্গে আনসার বাহিনীর সদস্যদেরও বেশ বেগ পোহাতে হয়।
কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার পর থেকেই ভাটা পড়ে যায় উদ্দীপনায়। কারণ চাঁদ ঢেকে যায় কালো মেঘের আবরণে। এ কারণে সন্ধ্যা থেকে দূরবীণ যন্ত্র দিয়ে নীল চাঁদ দেখতে এসে উৎসাহী লোকজন কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে। অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরাফেরা করে। কিন্তু চাঁদ দেখার জন্য লাইনে থাকা অগ্রভাগের লোকজন ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল।
তবে মেঘের ফাঁকে যখনই চাঁদ উকিঁ দিয়েছে তখনই বিচ্ছিন্ন থাকারা দ্রুত জড়ো হয়েছেন লাইনের পেছনে। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর থেকে পৌনে ১২টা পর্যন্ত যতক্ষণ চাঁদ দেখানো হয়েছে ততক্ষণই মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলে।
এদিকে, লোকজনদের জন্য উৎসবস্থলে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেখানে আবৃত্তি, গান পরিবেশন করে। গানের মধ্যে ছিল-- চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে; এখনি উঠিবে চাঁদ; ‘চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’ প্রভৃতি। চান্নি পসর রাইত পরিবশনার সময় দর্মকদের অনেকেই এগিয়ে যান মঞ্চের সামনে, কল কোলাহল অনেকটাই থেমে যায়- সম্ভবত গানটির রচয়িতা জ্যোছনা প্রেমী সদ্যপ্রয়াত জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি যেন তাদের আপ্লূত করে তোলে। পাশ থেকে কে যেন একজন বলে উঠলেন, হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তো আজ এখানে এই আয়োজনে শামিল হতেন।
যাহোক, চাঁদকে নিয়ে খ্যতিমানদের সৃষ্টি অমর কবিতা আর গানের পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় কবি আর গীতিকারদের লেখা কবিতা আর গানও পরিবেশন করা হয়। পরিবেশের আবেশে সেসবও লেগেছে অসাধারণ।
শিল্পীদের পাশাপাশি দর্শক নিজেরাও সুরে তুলেছিলেন এসব হৃদয়নিংড়ানো গানের। তাছাড়া প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর চাঁদ নিয়ে গাওয়া গানটির পবিরেবশনাও ছিল চমৎকার।
ফাঁকে ফাঁকে চলছিল ভিডিও চিত্র। এছাড়া বিজ্ঞান বক্তা আসিফ বিভিন্নজনের প্রশ্নের উত্তর দেন।
বিআইডব্লিউটিএ জেটিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টায় উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহ সভাপতি রফিউর রাব্বি।
এসময় উপস্থিত ছিলেন নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিকি, ভবানী শংকর রায়, বাবু প্রদীপ ঘোষ, পেশাদার বিজ্ঞানবক্তা আসিফ প্রমুখ।
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি প্রদীপ ঘোষ বাবু বাংলানিউজকে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে শুরু হয় নীল চাঁদ উৎসব। রাত ১২টা পর্যন্ত চলে চন্দ্র পর্যবেক্ষণ, তথ্যচিত্র প্রদর্শন, চাঁদকে নিয়ে গান ও কবিতার আসর। চাঁদ নিয়ে নানান প্রশ্ন আলোচিত হয় ওই আসরে।
‘মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা হলেও মানুষের মধ্যে ছিল না কোন উৎসাহের ঘাটতি’ বলেন প্রদীপ।
প্রসঙ্গত, কোনো মাসে যদি দুটো পূর্ণিমা হয় তবে দ্বিতীয় পূর্ণিমার চাঁদকে বলে ব্লু মুন বা নীল চাঁদ। এ রাতে চাঁদ ঠিক নীল হয় না, থাকে স্বাভাবিক অন্যান্য পূর্ণিমার চাঁদের মতই, তবে এসময় খানিকটা নীলচে দেখায় চাঁদকে। অবশ্য এই একটুতেই চাঁদের অপরূপ দ্যুতি মোহনীয় হয়ে ওঠে অনেকটাই। এই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় পৌনে ৩ বছর।
৩১ আগস্ট শুক্রবার ছিলো সে দিন। এ রাতে আকাশে দেখা দেয় জ্যোৎস্নাপ্রেমীদের প্রিয় ‘নীলচাঁদ’।
বাংলাদেশ সময় : ১১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর