ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৭ কার্তিক ১৪৩২, ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার

ইরানে শহীদের মর্যাদা ও শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা

আশরাফুর রহমান | তেহরান থেকে
আপডেট: ১৬:৪২, অক্টোবর ২২, ২০২৫
ইরানে শহীদের মর্যাদা ও শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৪৬ শহীদের দেহাবশেষ সম্প্রতি ফিরিয়ে আনা হয়

ইসলামি পরিভাষায় ‘শহীদ’ শব্দটির অর্থ হলো সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর পথে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেন। ইসলামে শহীদের মর্যাদা চিরন্তন।

ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা সেই নীতিকেই রাষ্ট্রীয় দর্শনে রূপ দিয়েছে।

ইরানে ধর্মীয় ও আইনগত উভয় কারণে শহীদদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়।  শহীদদের পরিবারকে সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এসব পরিবারের ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য শহীদদের পিতা-মাতা, সহধর্মিণী ও সন্তানদের আর্থিক, নৈতিক ও সামাজিক সহায়তা দেওয়া।


বেহেশত-ই জাহরায় অজ্ঞাতনামা শহীদদের কবরস্থানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা

শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণ

ইরানে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত। শহীদদের স্মরণে দেশজুড়ে রয়েছে হাজারো স্মৃতিসৌধ, ‘বেহেশত-ই জাহরা’ ও ‘বেহেশত-ই ফাতেমা’র মতো বিশেষ কবরস্থান এবং প্রায় প্রতিটি শহরে ‘গোরেস্তান-এ শোহাদা’ বা শহীদ সমাধিক্ষেত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি ভবনের নাম শহীদদের নামে রাখা হয়, এমনকি রাস্তাঘাট, মেট্রোস্টেশন, বাসস্টপ, ব্রিজ ও পার্কের নামেও শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখা হয়েছে।


হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় শহীদের মর্যাদা পান ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন কর্মকর্তা

পাঠ্যপুস্তকে শহীদদের জীবন ও আদর্শ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শহীদদের নিয়ে রেডিও-টেলিভিশনে নিয়মিত বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। পাশাপাশি চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলা ও সংগীতে শহীদদের আত্মত্যাগের আদর্শকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়া হয়।

ইরানে শহীদ কারা?

ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সাহিত্যে ‘শহীদ’ বলতে বোঝায় সেইসব ব্যক্তিকে, যারা ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের অর্জন, ইসলামি ব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষা, ইরানের স্বাধীনতা এবং শত্রুদের হুমকি মোকাবিলায় জীবন উৎসর্গ করেছেন।


১৯৮১ সালে সন্ত্রাসী হামলায় শাহাদাতবরণ করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজায়ি (ডানে), প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ বাহোনার (বামে)

ইরানের শহীদ ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, ১৯৭৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। এদের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে কয়েকটি পরিভাষায়:

১. শোহাদায়ে ইনকিলাব (বিপ্লবের শহীদ): পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহত প্রায় ৬০,০০০ মানুষ এই শ্রেণির শহীদ। ১৯৮১ সালের ২৮ জুন তেহরানের ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির সদর দপ্তরে সংঘটিত বোমা হামলায় নিহত ৭২ জন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি— যেমন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজায়ি, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ বাহোনার, বিচারক, সংসদ সদস্য ও আলেমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শোহাদায়ে ইনকিলাব’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত।

২. শোহাদায়ে দেফায়ে মোকাদ্দাস (পবিত্র প্রতিরক্ষার শহীদ): ১৯৮০-১৯৮৮ সালে সংঘটিত ইরান-ইরাক যুদ্ধে ১৮০,০০০-২০০,০০০ ইরানি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন, যাদের ‘আরোপিত যুদ্ধের শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

৩. শোহাদায়ে গোমনাম (অজানা শহীদ): ইরান-ইরাক যুদ্ধের সেইসব নিহত ইরানি যাদের পরিচয় অজানা। ইরানে সাধারণত তাদের সমাধিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাদের সমাধির পাশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

৪. শোহাদায়ে মোদাফেন-ই হারাম (হারামের রক্ষক শহীদ): ইরান, সিরিয়া ও ইরাকে পবিত্র মাজার রক্ষা করতে গিয়ে আইএস বা দায়েশ জঙ্গিদের হামলায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তারা এই শ্রেণির শহীদ।

৫. শোহাদায়ে আমনিয়াত (নিরাপত্তার শহীদ): যারা সমাজে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষা এবং চোরাচালানকারী ও দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিহত হন।

৬. শোহাদায়ে সেহহাত (স্বাস্থ্যের শহীদ): যারা ইরানের জনগণের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে তাদের জীবন হারান। ২০১৯ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় এই উপাধিটি প্রচলিত হয়।

৭. শোহাদায়ে খেদমত (সেবার শহীদ): যারা জনগণের সেবায় তাদের জীবন হারান। ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি, ইরানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান প্রমুখ।

৮. শোহাদায়ে মোকাওমাতে ইসলামি (প্রতিরোধের শহীদ): ২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১,০৬২ জনকে ইরানি গণমাধ্যম ‘শোহাদায়ে মোকাওমাতে ইসলামি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই ধারণাটি শহীদ কাসেম সোলাইমানির দর্শনের সঙ্গে যুক্ত, যেখানে ইসলামি প্রতিরোধকে একটি ঐক্যবদ্ধ ন্যায়সংগ্রাম হিসেবে দেখা হয়।


ইসরায়েলি হামলায় শহীদ ইরানি সামরিক কর্মকর্তারা

এ ছাড়া ২০১৫ সালে হজের সময় মিনার বিপর্যয়, প্লাস্কো ভবন ধস ও ইউক্রেনীয় বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদেরও ‘শহীদ’ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যা ইরানে শহীদের ধারণাকে কেবল যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি বরং মানবসেবা ও জাতীয় কর্তব্যে ‘আত্মত্যাগের প্রতীক’ হিসেবে প্রসারিত করেছে।

প্রসঙ্গত: কোন একটি মৃত্যু শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে কি না—এটি নির্ধারণ হয় সরকারি নির্দিষ্ট যাচাই-প্রক্রিয়ার (কাগজপত্র, ঘটনাস্থল/কর্মকাণ্ড যাচাই ইত্যাদি) মাধ্যমে।

শহীদ পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় সুবিধা

ইরানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কল্যাণব্যবস্থা বিদ্যমান। এর দায়িত্বে রয়েছে ‘শহীদ ও ইহসান ফাউন্ডেশন’, যা সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত।

শহীদ পরিবারের প্রধান সুবিধাগুলো হলো:

১. মাসিক ভাতা: শহীদের স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানরা মাসিক আর্থিক ভাতা পান। শহীদের পরিবারের ভাতা সর্বোচ্চ ১৫০ মিলিয়ন রিয়াল (প্রায় ১২৫ মার্কিন ডলার)। প্রতি বছর ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়।

২. বাসস্থান ও ঋণ সুবিধা: শহীদ পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বা ভর্তুকিযুক্ত আবাসন, গৃহঋণ ও নির্মাণসহায়তা দেওয়া হয়।

৩. শিক্ষা কোটা: শহীদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ভর্তি কোটাসহ বৃত্তি দেওয়া হয়।

৪. চিকিৎসা ও বিমা সুবিধা: সকল পরিবারের সদস্য রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমার আওতাভুক্ত এবং বিশেষ চিকিৎসা কার্ড পান।

৫. চাকরি ও অগ্রাধিকার: সরকারি চাকরিতে শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট শতাংশ কোটাসংরক্ষিত।

৬. সাংস্কৃতিক সম্মাননা: শহীদের নামে রাস্তা, স্কুল, পার্ক ও মসজিদের নামকরণ করা হয়, পরিবারগুলোকে বার্ষিক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সম্মানিত করা হয়।

শহীদ ফাউন্ডেশনের ভূমিকা

‘বুনিয়াদ-এ শহীদ’ বা ‘শহীদ ফাউন্ডেশন’ ১৯৮০ সালে ইসলামি বিপ্লবের নেতা  আয়াতুল্লাহ খোমেনি (রহ.)-এর নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। সংস্থাটির কাজ শুধু আর্থিক সহায়তা নয়; বরং শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ, আত্মত্যাগের আদর্শ প্রচার এবং প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি বিপ্লবের চেতনা জাগিয়ে রাখা। এই ফাউন্ডেশনের অধীনে ‘মোকাভেমাত মিউজিয়াম’ ও ‘শোহাদা আর্কাইভ’ রয়েছে, যেখানে যুদ্ধকালীন নথি, ছবি ও জীবনী সংরক্ষিত।

শহীদেরা ইসলামি ইরানের আত্মা

ইরানে শহীদের ধারণা কেবল ধর্মীয় নয়, এটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক। ইসলামি বিপ্লবের পর শহীদরা হয়ে উঠেছেন ‘ইসলামি ইরানের আত্মা’—যাদের রক্তে নির্মিত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি। রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সম্মানের মাধ্যমে শহীদ পরিবারগুলোকে শুধু আর্থিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও জাতির কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেওয়া হয়েছে।


শহীদ কাসেম সোলাইমানির ছবি হাতে শোক মিছিল

যুদ্ধক্ষেত্র হোক বা চিকিৎসাকেন্দ্র, নিরাপত্তা ফ্রন্ট হোক বা প্রতিরোধ অক্ষ—যেখানে কেউ ইসলামি মূল্যবোধ ও মানবতার পক্ষে প্রাণ দেয়, ইরান সেখানে তাকে এক নামেই স্মরণ করে: ‘শহীদ’।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।