ঢাকা: ‘আলো’ (Light) শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কারণ, আলোর জন্যই আমরা সবকিছু দেখতে পাই।
আলো যদি না থাকতো, তাহলে আমরা দিনের পর দিন না খেয়ে অনাহারে মরে যেতাম। আবার এই মানুষকে যদি একটি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরের ভেতর অনেক দিন আটকে রাখা যায়, তাহলে সে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, চোখের ভেতর এক ধরনের কোষ আছে, যেগুলো আলোর অভাবে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
পানির অপর নাম যেমন ‘জীবন’, একইভাবে ঠিক সেরকম আলোকেও এই অর্থে ‘জীবন’ বলা যায়।
আলো অনেক উৎস থেকেই আসে। যেমন- সূর্য (তারকা), গ্যালাক্সি, বিভিন্ন রকম জ্বালানি (যেমন- কাঠ, গ্যাস) আবার বিভিন্ন রকম বৈদ্যুতিক বাতি, বৈদ্যুতিক স্ফূলিঙ্গ থেকে তৈরি হয়। আরো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আলো তৈরি হয়। এক পাথরের সঙ্গে আরেকটি পাথর ঘষলেও তার স্ফূলিঙ্গ থেকে আলো তৈরি হয়।
বিজ্ঞানে আলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিকতার বিশেষ সূত্রগুলি আলোর ওপর (বিশেষ করে আলোর গতিবেগের ওপর) ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তবে আলো কী বা কী দিয়ে তৈরি, এর আচরণ কেমন, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও অনেকটা হিমসিম খান। একেক রকম পরীক্ষায় আলোর আচরণও একেক রকম বলে মনে হয়। ফলে, বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা আলো সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকেন।
বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, ‘আলো’ হচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য কণিকা দিয়ে গঠিত এবং ওই কণিকাগুলির কোনো ওজন নেই। এই কণিকার নাম হলো ‘ফোটন’ (Photon)। যে কোনো উৎস থেকেই এই কণিকা অর্থাৎ ফোটনগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পদার্থ বিজ্ঞানী হাইগেন্স বলেন, ‘আলো’ চলে তরঙ্গের মতো করে।
এদিকে, আবার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বলে বসলেন আরেক কথা। তার মতানুসারে, ‘আলো’ চলে গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বা প্যাকেট প্যাকেট আকারে (একে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে)।
আমরা জানি, আলো সোজা পথে চলে। অর্থাৎ উৎস থেকে যেদিক দিয়ে বের হয়, ঠিক সেদিক দিয়ে সোজা চলতে থাকে। এঁকেবেঁকে অন্য কোনো দিক দিয়ে চলে যায় না। তবে শক্তিশালী কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আলো সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে কিছুটা বেঁকে যায়।
আলোর নির্দিষ্ট গতিবেগ আছে এবং তা হলো শূন্যস্থানে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার অর্থাৎ কোনো উৎস থেকে বের হয়ে এটি প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার করে দূরে চলে যাবে।
শূন্যস্থান/মহাশূন্য (পৃথিবীর বাইরে সমস্ত ফাঁকা জায়গাগুলোকে শূন্যস্থান বলা যেতে পারে) কথাটি বলার কারণ হলো, আলো বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন বেগে চলে। তবে শূন্যস্থানেই আলো দ্রুত বেগে চলে। কারণ, শূন্যস্থানে আলো বাধা পায় না। তবে বাতাসের মধ্যে আলোর বেগ আর শূন্যস্থানে আলোর বেগ একই ধরা হয়। যদিও বাতাসের মধ্যে দিয়ে চলার সময় বাধা পাওয়ায় আলো একটু ধীরে চলে। খুব একটা ধীরে চলে না বলেই এই দুই স্থানের মধ্য দিয়ে আলোর বেগকে একই ধরা হয়।
তবে বিভিন্ন ‘মাধ্যম’-এর (Medium) ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। মাধ্যম যত বেশি ঘন হবে, সেখানে আলোর বেগও তত কম হবে। যেমন- শূন্যস্থানে আলো যে বেগে চলে, পানির মধ্য দিয়ে তার চার ভাগের তিনভাগ বেগে চলে। অর্থাৎ পানিতে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩/৪*৩০০০০০=২২৫০০০ কিলোমিটার বা দুই লাখ ২৫ হাজার কিলোমিটার। আর কাচের মধ্যে আলোর বেগ শূন্যস্থানের তিন ভাগের দুইভাগ বেগে চলে মাত্র।
ধরা যাক, এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। রাস্তাটি ফাঁকা হলে তিনি যত জোরে হেঁটে যেতে পারবেন, রাস্তাটি যদি প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকে, তাহলে তিনি খুব বেশি জোরে হাঁটতে পারবেন না। আলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ কণা অর্থাৎ ফোটনগুলো কোনো মাধ্যম দিয়ে যাওয়ার সময় মাধ্যমের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ফলে তার চলার গতিও কমে যায় (এখানে মাধ্যমগুলোকে অবশ্যই স্বচ্ছ অর্থাৎ পানি বা কাচ হতে হবে। অস্বচ্ছ মাধ্যম যেমন- কাঠ, ঘরের দেওয়াল ইত্যাদি, এগুলোর মধ্যে দিয়ে আলো চলতে পারে না। )
আলোর গতিতে চলতে পারে এমন কোনো যানবাহনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আইনস্টাইন বলেছেন, কোনো বস্তুই আলোর গতিতে অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে না।
আলোর গতির মাপ
প্রশ্ন হলো, আলোর এমন প্রচণ্ড বেগ কীভাবে মাপা হয়? যে কোনো গাড়ির সঙ্গে গতি মাপার মিটার বসানো থাকে এবং সেই মিটার থেকেই বোঝা যায়, গাড়িটি ঘণ্টায় কত কিলোমিটার বেগে চলছে। কিন্তু আলোর সঙ্গে তো আর তেমন কোনো মিটার বা অন্য কোনো যন্ত্র বসানো সম্ভব নয়। কারণ, আলোকে ধরাও যায় না, আবার ছোঁয়াও যায় না।
ওই ফোটনগুলো খুবই ছোট। এতই ছোট যে, এদের কোনো দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে ভর মাপতে গেলে কোনো ভারই পাওয়া যাবে না। অবশ্য বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমেও এর অস্তিত্ব বোঝা যায় না। এসব কারণেই এর গতিবেগ মাপার জন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতির দরকার। আর এখন আমরা দেখবো, বিজ্ঞানীরা প্রথম কীভাবে আলোর গতিবেগ মাপলেন।
আলোর গতিবেগ এ রকম প্রচণ্ড হওয়ার কারণে প্রাচীনকালের বিজ্ঞানীদের এই গতিবেগ পরিমাপের সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ হয় এবং সতেরশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, আলোর বেগ হলো ‘অসীম’। অর্থাৎ যা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। যেমন- দেকার্তে নামে এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলোর বেগকে অসীম বলে দাবি করেন। অন্যদিকে, ১৬৬৭ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক গ্যালিলিও আলোর বেগকে ‘সসীম’ বলে দাবি করেন ও সর্বপ্রথম তিনিই এর বেগ নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পদ্ধতিতে ভুল থাকায় আলোর বেগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন তিনি।
পরে ১৬৭৫ সালে কোপেন হেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওলফ রোমার প্যারিসে কাজ করার সময় বৃহস্পতি গ্রহের একটি উপগ্রহের গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে সর্বপ্রথম আলোর বেগ নির্ণয় করেন। আর একেই বলা হয়, রোমারের জ্যোতির্বিদীয় পদ্ধতি।
তবে তিনি এই কাজটি করার জন্য অর্থাৎ বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহটি পর্যবেক্ষণের জন্য যে টেলিস্কোপটি ব্যবহার করেন, তা গ্যালিলিওরই আবিষ্কার আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তিনি যে উপগ্রহটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই কাজটি করেন, সেটিও গ্যালিলিওই আবিষ্কার করেন (উপগ্রহটির নাম ‘আয়ো’)।
গ্যালিলিও ১৬১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি একাটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে সেটা দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহ দেখতে থাকলেন। দেখতে দেখতে সেই সময়ই তিনি বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। উপগ্রহ চারটির নাম ‘আয়ো’, ‘ইউরোপা’, ‘গ্যানিমিড’ ও ‘ক্যালিস্টো’ এবং বর্তমান হিসাব পর্যন্ত এগুলোই বৃহস্পতির সবচেয়ে বড় উপগ্রহ।
এবার দেখা যাক, তিনি কীভাবে ‘আয়ো’-এর গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে আলোর গতি নির্ণয় করেন। তবে তার পদ্ধতিটি বর্ণনা করার আগে আমরা একটি উদাহরণ আলোচনা করে নিই।
উদাহরণ ১: ধরা যাক, এক ব্যক্তি মাঠে একটি বল রেখে সেখান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তার চারপাশ দিয়ে বৃত্তাকার পথে হাঁটতে লাগলেন। আবার আরেক ব্যক্তি ওই বলটি থেকেই আরও কিছু দূরে গিয়ে একইভাবে ওই বলের চারপাশ দিয়ে বৃত্তকার পথে হাঁটতে লাগলেন।
এক্ষেত্রে বলের চারপাশ দিয়ে একবার ঘুরে আসতে প্রথম ব্যক্তির যে সময়টা লাগবে দ্বিতীয় ব্যক্তির তার চেয়ে বেশি সময় লাগবে। কারণ, দ্বিতীয় ব্যক্তিকে প্রথম ব্যক্তির চেয়ে বেশি পরিমাণ হাঁটতে হচ্ছে। আবার প্রথম ব্যক্তি যদি দ্বিতীয় ব্যক্তির তুলনায় দ্রুতগতিতে অর্থাৎ জোরে জোরে হাঁটেন তবে তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তির চেয়ে আরও কম সময়ে বলটির চারপাশ দিয়ে হেঁটে আসতে পারবেন। আর এভাবেই তারা যদি হাঁটতে থাকেন, তাহলে একটি ঘটনা ঘটবে। তা হলো, ব্যক্তি দু’জন এক সময় পরস্পরের খুব কাছে চলে আসবেন। আবার আরেক সময় তারা পরস্পর থেকে খুব দূরে সরে যাবেন।
এক সময় তারা বলের একই দিকে এবং একই রেখা বরাবর থকবেন। তখন তারা সবচেয়ে কাছে থাকবে। আবার আরেক সময় তারা বলের বিপরীত দিকে এবং একই রেখা বরাবর থাকবেন তখন তারা পরস্পর কাছে থেকে সবচেয়ে দূরে থাকবেন। দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যক্তি দু’জন আর বল একই সরল রেখা বরাবর থাকবে এবং এই কাছে থাকা এবং দূরে থাকার ব্যাপারটা নির্দিষ্ট সময় পর পর বার বার ঘটতে থাকবে। বলের স্থানে সূর্য, প্রথম ব্যক্তির স্থানে পৃথিবী ও দ্বিতীয় ব্যক্তির স্থানে বৃহস্পতিকে রাখলে ব্যাপারটি একই রকম ঘটবে।
কারণ, বৃহস্পতির তুলনায় পৃথিবী সূর্যের অনেক কাছে। সূর্য থেকে আমাদের পৃথিবীর গড় দূরত্ব প্রায় ১৪ কোটি ৯৬ লাখ কিলোমিটার বা ৯ কোটি ৩০ লাখ মাইল আর বৃহস্পতির দূরত্ব প্রায় ৭৭ কোটি ৮৩ লাখ কিলোমিটার বা ৪৮ কোটি ৩৬ লাখ মাইল।
আবার বৃহস্পতি যে বেগে সূর্যের চারদিক দিয়ে ছুটে চলে, তার তুলনায় পৃথিবী অনেক বেশি গতিতে ছুটে চলেছে। যেমন- পৃথিবীর কক্ষের গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ২৯.৭৯ কিলোমিটার আর বৃহস্পতির ১৩.০৬ কিলোমিটার (গ্রহগুলো যে বেগে সূর্যের চারপাশ দিয়ে ঘোরে তাকে কক্ষীয় গতিবেগ বলে) যে কারণে পৃথিবী সূর্যের চারদিক দিয়ে ঘুরতে সময় নেয় প্রায় এক বছর বা ৩৬৫.২৪ দিন। আর বৃহস্পতি সময় নেয় প্রায় ১১.৮৬ বছর বা ৪,৩৩১.৮৭ দিন।
ফলে এক সময় পৃথিবী ও বৃহস্পতি পরস্পরের সবচেয়ে কাছে চলে আসে অথবা বলা যায়, এদের মধ্যকার দূরত্ব ন্যূনতম হয়। আবার এক সময় এরা পরস্পর থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে চলে যায় বা বলা যায় এদের মধ্যকার দূরত্ব বৃহত্তম হয়।
যখন দূরত্ব ন্যূনতম হয়, তখন এদের মধ্যে ‘সংযোগ’ হয়েছে বলা হয়, আর দূরত্ব যখন বৃহত্তম হয়, তখন ‘প্রতিযোগ’ হয়েছে বলা হয়। আর এই ‘সংযোগ’ ‘প্রতিযোগ’ ঘটনাটি প্রতি সাত মাস পর পর ঘটে থাকে।
উদাহরণ ২: আবার চন্দ্রগ্রহণ কীভাবে হয় এটা তো আমরা সবাই জানি। যখন চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্য একই রেখায় অর্থাৎ একটি সরল রেখা বরাবর অবস্থান করে এবং চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে যখন পৃথিবী থাকে, তখনই চন্দ্রগ্রহণ হয়। বৃহস্পতি গ্রহেরও চাঁদের মতো উপগ্রহ রয়েছে এবং তা একটি বা দুটি নয় ১৬টি।
আর এদের মধ্যেও গ্রহণ সংঘটিত হয় ঠিক একইভাবে। অর্থাৎ বৃহস্পতির উপগ্রহ, বৃহস্পতি ও সূর্য একই সরল রেখা বরাবর আর সেই উপগ্রহ ও সূর্যের মাঝখানে যখন বৃহস্পতি থাকে।
আবার চন্দ্রগ্রহণও কিন্তু নির্দিষ্ট সূত্রের নিয়মে নির্দিষ্ট সময় পর পর সংঘটিত হয়। আর এভাবেই বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন, কোন সময় থেকে চন্দ্রগ্রহণ শুরু হবে। বৃহস্পতি আর তার উপগ্রহের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা অর্থাৎ বৃহস্পতির উপগ্রহগুলির ক্ষেত্রে গ্রহণ কোন সময় শুরু হবে, তা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে বসেই হিসাব করে বলে দিতে পারেন।
কিন্তু পৃথিবীর উপগ্রহের গ্রহণ অর্থাৎ চন্দ্রগ্রহণ সংঘটিত হয়, কয়েক বছর পর পর। কিন্তু বৃহস্পতির উপগ্রহ ‘আয়োর’ ক্ষেত্রে এই গ্রহণটি সংঘটিত হয় মাত্র ৪২১/২ ঘণ্টা পর পর। অর্থাৎ বিষয়টি এ রকম ধরা যাক- ঠিক এই মূহূর্তে একটি গ্রহণ শুরু হলো, তাহলে এর ঠিক ৪২১/২ ঘণ্টা পর আবার গ্রহণ শুরু হবে এবং এভাবেই চলতে থাকবে।
কিন্তু রোমার বৃহস্পতি ও ‘আয়ো’র গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখেন যে, গ্রহণ ঠিক যে সময় শুরু হওয়ার কথা, ঠিক সে সময় শুরু হচ্ছে না। যদিও হিসাবে সেই নির্দিষ্ট সময়েই শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু বছরের কোনো কোনো দিন তার ঠিক কিছু পরে গ্রহণটি দেখা যাচ্ছে (বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহের মধ্যে গ্রহণ আমাদের এই পৃথিবী থেকেও দেখা যায়, টেলিস্কোপের মাধ্যমে)।
রোমার এই অতিরিক্ত সময় লাগার বিষয়টি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখেন যে, পৃথিবী ও সূর্য যখন ন্যূনতম দূরত্বে থাকে অর্থাৎ যখন ‘ক’ অবস্থানে থাকে (চিত্রানুযায়ী) তখন সঠিক সময়ে গ্রহণটি দেখা যায়। কিন্তু এই দূরত্ব যখন সাত মাস পর বৃহত্তম হয় অর্থাৎ যখন ‘খ’ অবস্থানে থাকে, তখন নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে গ্রহণটি শুরু হতে দেখা যায়।
এই দেরি হওয়ার কারণটি তিনি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আলোর বেগ যদি অসীম হতো, তাহলে এই গ্রহণ বছরের সব দিনই একই সময় পর পর দেখা যেত। কিন্তু আলোর বেগ অসীম নয়, তার একটি নির্দিষ্ট গতিবেগ আছে অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে একটি নির্দিষ্ট সময় লাগে। কিন্তু আলোর বেগ যদি অসীম হতো, তাহলে যে কোনো দূরত্ব পার করতে তার কোনো সময়ই লাগত না। ফলে পৃথিবী ও বৃহস্পতি ন্যূনতম দূরত্ব বা বৃহত্তম দূরত্ব যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, সব ক্ষেত্রে একই সময় পর পর গ্রহণটি দেখা যেত।
আর আলোর বেগ সসীম হওয়ার জন্যই পৃথিবী যখন ন্যূনতম থেকে বৃহত্তম দূরত্বে যাচ্ছে অর্থাৎ ‘ক’ থেকে ‘খ’-তে যাচ্ছে, তখন বৃহস্পতি থেকে পৃথিবীর ২৯ কোটি ৯০ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য পৃথিবী যখন ‘খ’ অবস্থানে থাকছে, তখন আলোর এই অতিরিক্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে যে অতিরিক্ত সময়টি লাগছে, ঠিক সেই সময় পরই আমরা বৃহস্পতির গ্রহণটি দেখতে পাচ্ছি।
আর আমরা জানি, কোনো স্থান, বস্তু বা উৎস থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পৌঁছালে আমরা সেই স্থান, বস্তু বা উৎসকে দেখতে পাই। আর তা যদি আমাদের থেকে অনেক দূরে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আলো এসে পৌঁছাতে সময় লাগবে। আর সেখানে যদি কিছু ঘটে থাকে, তাহলে ঠিক যখন ঘটলো তার কিছু সময় পর আমরা তা দেখতে পাবো।
ধরা যাক, আমাদের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে একটি টেবিলের ওপর একটি বল রাখা আছে। আমরা একটি শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে তা দেখছি। বলটি হঠাৎ টেবিল থেকে নিচে পড়ে গেল। বলটি ঠিক যে মূহূর্তে পড়লো, ঠিক সেই মূহূর্তেই কিন্তু আমরা বলটির পড়ে যাওয়া দেখতে পাবো না। কারণ, বলটির পড়ে যাওয়ার সময় বল থেকে যে আলো আমাদের দিকে আসবে, সেটি ওই অনেক দূরের পথ অতিক্রম করে আসতে সময় নেবে। অর্থাৎ পড়ে যাওয়ার মূহূর্তের আলোটি সেই পথ পার হয়ে এসে আমাদের চোখে যখন পৌঁছাবে, ঠিক তখনই আমরা বলটি পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পাবো।
এবার রোমার যে কাজটি করলেন, তা হলো- পৃথিবী ও বৃহস্পতির ন্যূনতম ও বৃহত্তম, এই দুই অবস্থানে বা দূরত্বে থাকার সময় ‘আয়োর’ যে গ্রহণগুলো সংঘটিত হয়, তাদের সময়ের হিসাব করে অতিরিক্ত সময়টি বের করেন।
আর এই সময়ে অতিরিক্ত যে দূরত্বটি বৃদ্ধি পেলো অর্থাৎ ‘ক’ থেকে ‘খ’ এর দূরত্বটি তো আগে থেকেই জানা ছিল (কারণ ওটা হলো পৃথিবীর ব্যাস)। সেই অতিরিক্ত সময় দিয়ে অতিরিক্ত দূরত্বকে ভাগ করলে একক সময়ে অর্থাৎ এক সেকেন্ডে আলো কতখানি দূরে যাচ্ছে, সেটি বের করেন। আর এটাই হলো আলোর বেগ।
তার হিসাব অনুযায়ী, অতিরিক্ত দূরত্বটি হলো- ২৯,৯০,০০,০০০ আর অতিরিক্ত ১০০০ সেকেন্ড, যা ভাগ করলে দাঁড়ায় ২,৯৯,০০০ কিলোমিটার বা ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ডে।
সুতরাং বন্ধুরা আর দেরি নয়। এবার একটি টেলিস্কোপ নিয়ে কাজে লেগে পড়া যাক। আমরাও চেষ্টা করে দেখি, রোমারের মতো করে বৃহস্পতির উপগ্রহ আয়োকে পর্যবেক্ষণ করে নিজেরাই আলোর গতিবেগ মাপতে পারি কিনা।
লেখক: মো. ফয়সাল ইসলাম, মহাকাশ গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৫
এটি