জ্বলজ্বলে দুটি চোখ। শরীরের আকারের তুলনায় একটু বড়ই।
আগের দিনে বসতবাড়ির আশপাশে গাছের ডালে ঝোপের আড়ালে দেখা যেত ভাবগম্ভীর হয়ে বসে আছে হুতুম পেঁচা। নিশাচর এই পাখি অন্ধকারে ভয়ঙ্করভাবে ডাকাডাকি করত। ছোটবেলায় আমরা পেঁচা দেখে, পেঁচার ডাক শুনে ভয়ও পেতাম। কারণ ভয় দেখানোর জন্য বা কান্না থামানোর জন্য বড়রা হুতুম পেঁচার ভয় দেখাত যখন তখন। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। সারাদিন খোঁজাখুজি করেও একটা পেঁচার সন্ধান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ আমাদের দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই ভয়ঙ্কর সুন্দর পাখিটি।
পেঁচার বংশলতিকা বেশ লম্বা। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে থেকে ওরা এই পৃথিবীর জল-হাওয়ায় বসবাস করছে। ওদের চোখের সামনেই অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হলেও ওরা আজও টিকে আছে প্রায় একই চেহারা নিয়ে। সব দেশের আবহাওয়ায় প্রায় সমান স্বাচ্ছন্দ্যে ওরা বেঁচে থাকতে পারে। প্রজাতিভেদে পেঁচা ২০ বছর পর্যন্ত বাঁচে।
পৃথিবীতে কয়েক ধরনের পেঁচা বেশ উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো : সাদা ফোটার পেঁচা (Spotted Owl), ঈগল পেঁচা (Eagle Owl), শিংওয়ালা পেঁচা (Great Horned Owl), লম্বা কানের পেঁচা (Long-eared Owl), মুখোশধারী পেঁচা (Masked Owl) ইত্যাদি। এদের মধ্যে ঈগল পেঁচা দেখতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
প্রাচীনকাল থেকেই পেঁচার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিছুটা জটিলভাবে। এক্ষেত্রে অবশ্য পেঁচা বেচারার কোনোই ভূমিকা নেই। কারণ পেঁচা পোষ মানে না বা সরাসরি মানুষের কোনো কাজে লাগে না। এমনকি ওরা মানুষের কোনো তিও করে না। তারপরও মানুষ পেঁচা নিয়ে তৈরি করেছে গল্প, সংস্কার কিংবা লোকবিশ্বাস। আর তাই মানবসভ্যতার সঙ্গে পেঁচা হয়ে আছে এক কিংবদন্তির চরিত্র। যেমন, কয়েক দশক আগেও ক্যামেরনের মানুষ পেঁচাকে কোনো নাম ধরে ডাকত না। ‘যে পাখি ভয় দেখায়’ এই কথাটি বললেই সেখানে সবাই বুঝে নিত কোন পাখির কথা বলা হচ্ছে।
প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রে পাখিদের মধ্যে একমাত্র পেঁচার ছবিই পাওয়া গেছে। এটা শুধু একটি অঞ্চলে নয়, অনেক সভ্যতার মানুষই পেঁচাকে প্রতীক হিসেবে গুহাচিত্র এবং লিপিতে ব্যবহার করত। প্রাচীন মিশরের লিপিতেও আমরা পেঁচার চিত্র দেখতে পাই।
পেঁচা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন লোককথা। এবার চলুন কিছুটা ধারণা নেওয়া যাক সেসব লোককথা বিষয়ে।
প্রাচীন গ্রিসে পেঁচা ভাগ্যবিধাতা হিসেবে চিহ্নিত হতো। রোমানরা আবার পেঁচাকে দুঃখ-দুর্দশার প্রতীক মনে করত। পেঁচার ডাক শুনলে মৃত্যু হয়, এমন কুসংস্কারও ছিল তাদের মধ্যে।
প্রাচীন আমেরিকান ইন্ডিয়ান বিভিন্ন আদিবাসীরা পেঁচাকে বিভিন্নভাবে দেখত। কেউ মনে করত পেঁচা অসুস্থতা এবং মৃত্যুর প্রতীক। কেউ মনে করত পেঁচাই তাদের রাকর্তা।
কোনো কানো দেশের মানুষ এখনো মনে করে, পেঁচা সদ্যজাত শিশুর শত্রু। মালয়ের মানুষ এক সময় বিশ্বাস করত, সুযোগ পেলে পেঁচা সদ্যজাত শিশুকে খেয়ে ফেলে। আরবরা বিশ্বাস করত পেঁচার দানবীয় শক্তি আছে আর সেই শক্তিবলে সে রাতের অন্ধকারে শিশুদের ধরে নিয়ে যায়। তারা আরো মনে করত পেঁচার জাদুকরী শক্তি আছে।
আলজেরিয়ানরা বিশ্বাস করত পেঁচা যদি কোনো ঘুমন্ত নারীর হাতে ডান চোখের দৃষ্টি দেয়, তাহলে সে ত্রিকালদর্শী হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশরা বিশ্বাস করত পেঁচার ডাক শুনলে অবিবাহিত মেয়েরা সতীত্ব হারায়। তাছাড়া তারা আরো বিশ্বাস করত গর্ভবতী মা পেঁচার ডাক শুনলে গর্ভের সন্তান আশীর্বাদপুষ্ট হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় বিশ্বাস করা হতো, পেঁচার ঔষধি গুণ আছে। আর তাই পেঁচার হাড়-মাংস-রক্ত দিয়ে তৈরি করা হতো রাতকানাসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ।
জাপানের এক আদিবাসী সম্প্রদায় এখনো পেঁচাকে গ্রামের ঈশ্বর বলে মনে করে। চীনে পেঁচাকে ডাকা হয় ‘কানওয়ালা’ বলে।
রাশিয়ার শিকারিরা শিকারে যাওয়ার সময় পেঁচার নখর সঙ্গে রাখত। তারা মনে করত, শিকারে গিয়ে মরে গেলে পেঁচার নখরই তাদের স্বর্গে নিয়ে যাবে।
এছাড়া পেঁচা নিয়ে আরো অনেক অনেক লোককথা আর বিশ্বাস ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর দেশে দেশে। আর তাই মনে হয়, পেঁচাই একমাত্র পাখি যাকে নিয়ে মানুষের এত গল্প বোনা।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫২১, আগস্ট ০৪, ২০১০