আজ থেকে ড্র বলে আর কিছুই থাকছে না। এই বিশ্বকাপে কাউকে হারতে হবে।
সুতরাং রাউন্ড সিক্সটিনের প্রথম দিনে আজ হেরে গিয়ে পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকছে না চিলি, ব্রাজিল, কলম্বিয়া বা উরুগুয়ে- কোনো দলেরই। একথা প্রযোজ্য আগামী তিনদিন খেলতে নামবে বাকি যে বারো দল, তাদের জন্যও। এই রাউন্ড শেষে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল বা ফাইনালের কিচ্ছা তো একই। পরাজয় মানে বিদায়। ব্যতিক্রম শুধু এক ম্যাচ। দুই সেমি'তে যারা হারবে তারা পাবে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলার সুযোগ।
সত্যি কি জানেন, এই স্থান নির্ধারণী ম্যাচটার প্রতি দর্শকের আগ্রহ বরাবরই কম। দীর্ঘ একটা আসরের সঙ্গে দিনরাত কাটিয়ে 'পরাজিত'দের এই খেলা দেখতে কেনইবা এতো ভালো লাগবে। তার চেয়ে বরং অন্য কাজ করাই ভালো। ফাইনালের আগের দিনটায় একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলেওতো মন্দ হয় না।
কোন ম্যাচে কে জিতবে আজ ? কোটি কোটি মানুষের মুখে এই প্রশ্ন। এমন হয়ে আসছে প্রতিযোগিতার পয়লা দিন থেকেই। 'কে জিতবে' প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ একটা কাজ। তা অবশ্য যারা ফুটবল-বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক, ভাষ্যকার, সাংবাদিক-তাদের জন্য না। জ্যোতিষদের জন্য। ওই জ্যোতিষী পেশার 'ভবিষ্যৎ-বেচা' ব্যবসায়িরা কিভাবে যে খেলার আগেই বলে দেন অমুক দল ২-০ গোলে জিতবে , তমুক প্লেয়ার ৩ গোল করবে !
মজার বিষয় ,ওরা ১০০ বার এমন কথা বললে ৯৯ বার তা মেলে না। তবুও মানুষ ওদের গণনায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পত্রপত্রিকা, অনলাইন পোর্টালে ছাপা হওয়া নির্ভুল (!) ভবিষ্যৎবানী পড়তে কতোই না আগ্রহ মানুষের। মাঝেমাঝে ভাবি, আহারে... জ্যোতিষ যদি হতাম তাহলে তো এত কষ্ট করতে হতো না। দু'তিন লাইন লিখেই লেখা শেষ করে দিতাম কাউকে ২-০,২-১ এ জিতিয়ে দিয়ে।
যা হোক, যে কাজ আমার না তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে কি লাভ। খেলাতেই যাওয়া যাক।
আজকের নকআউট পর্বে প্রথম খেলতে নামছে ব্রিজিল-চিলি। এই খেলায় প্রশ্নাতীত ফেভারিট ব্রাজিল। যদি না জিততে পারে তারা, তা হবে বড় এক অঘটন। যদিও যুক্তিবাদীরা বলবেন, দ্বিতীয় রাউন্ডে দলগুলোর মধ্যে শক্তির পার্থক্য অনেক কম; পরিষ্কার ফেভারিট কেউ না। মানলাম। তবে ইতিহাস বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
ব্রাজিল ৫ বার কাপ জেতা দল। কাপতো দূরে, ফাইনালেই যায়নি কোনোদিন চিলি। জীবনে একবারই সেমিফাইনালে উঠে হেরে গিয়েছিলো তারা। তা-ও আবার ৫২ বছর আগে। গত ১২ বছর ব্রাজিল হারেনি চিলির কাছে। গত ১২ ম্যাচে চিলিকে হারিয়েছে ব্রাজিল ১০ বার। বিশ্বকাপে এই দুই দলের দেখা অতীতে ৩ বার। সব বারই জিতেছে ব্রাজিল। আর ব্রাজিলের মাটিতে ব্রাজিলকে কোনোদিনই হারাতে পারেনি চিলি। ২০ বার হেরেছে চিলি, ড্র করেছে ৬ বার। নিজের দেশের মাটিতে ২০০২ সাল থেকে ৪০টা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে ব্রাজিল, যার একটাতেও হারেনি তারা । এ থেকে আরো একটা বিষয় ফুটে ওঠে, ঘরের দর্শকের চাপ সামলাতে যথেষ্টই সক্ষম তারা।
ইতিহাস একপাশে রেখে এই বিশ্বকাপে কে কেমন করেছে সেদিকে চোখ রাখলেও ব্রাজিলকে এগিয়ে রাখতে হবে। এক ড্র, দুই জয় নিয়ে বিশেষ করে শেষ খেলায় ক্যামেরুনের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত মানের ফুটবল উপহার দিয়ে ওরা উঠেছে পরের রাউন্ডে। অন্যদিকে চিলি নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও বর্তমান চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে হারিয়ে দিয়ে 'বড়'দের কাতারে চলে এসেছে।
তুলনামূলক আলোচনায় গেলে, একে তো স্বাগতিক দেশ তার উপর ধরা হচ্ছে এই বিশ্বকাপের অন্যতম দাবিদার ব্রাজিল। 'চিলি চ্যাম্পিয়ন হবে' এমন স্বপ্ন চিলিয়ানরাও দেখে কিনা সন্দেহ। তবে চিলি দলের মিডফিল্ড ব্রাজিলের চেয়ে কোনো অংশেই কম না। তাদের শক্তির মূল উৎসই মধ্যমাঠ। যেখানে আছে আরতুরো ভিদালের মতো পরীক্ষিত তারকা । মুলত ৩-৪-৩ ফর্মেশনে খেলতে অভ্যস্থ চিলি দলের এই ছকইতো বলে দেয় মধ্যমাঠের ওপর কতোটা নির্ভরশীল ওরা। ডিফেন্সে ওদের সমস্যা থাকতে পারে তবে আক্রমনাত্মক ফুটবল খেলে যে কোনো সময় যে কোনো দলকে দিশেহারা করে দিতে পারে এই দল। পাশাপাশি, লাতিন আমেরিকার দেশ বলে ব্রাজিলের পরিবেশ, আবহাওয়া, কোনোকিছুই তাদের বিপক্ষে না। ব্রাজিলে খেলা অনেকটা নিজের দেশের মাঠে খেলার মতোই ওদের জন্য।
অন্যদিকে ব্রাজিল দলের ফরোয়ার্ড লাইনে আছেন নেইমার। এই বিশ্বকাপে যাকে আটকে রাখতে পারেনি কোনো দলের রক্ষণভাগ। শুধু নেইমারই না পুরো দলটাই ভালো খেলতে শুরু করে দিয়েছে রাউন্ড সিক্সটিনে ওঠার কিছু আগে থেকে। অতএব নিজের দেশের মাটিতে, নিজের মানুষের চাক্ষুষ সমর্থনে, সোনালী ইতিহাসসমৃদ্ধ দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে ব্রাজিল যে কোনো বিচারেই আজকের খেলায় জেতার মতো দল।
বাংলাদেশের গভীর রাতে রিও'তে খেলতে নামবে কলম্বিয়া-উরুগুয়ে। এই ম্যাচটা বেশি আলোচনায় চলে আসছে লুই সুয়ারেজের কারণে। ইতালি ডিফেন্ডারের কাঁধে কামড় দিয়ে নিজের দলের বারোটাই বাজিয়ে দিয়েছেন সুয়ারেজ। তার অবিস্মরণীয় নৈপুণ্যে ইংল্যান্ডের মতো দলকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে ফেলে দিয়ে, ইতালির মতো দলকে ঘরছাড়া করে দিয়ে উরুগুয়ে যখন বোঝাতে শুরু করলো তাদের গতি অপ্রতিরোধ্য, এই বিশ্বকাপে তাদের দৌড় হবে অনেক লম্বা, তখনি পাশবিক কাজটা করলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার।
এই মুহূর্তে সুয়ারেজ ছাড়া উরুগুয়ে সাদামাটা একটা দল - এমনই বলছেন সবাই। এখন হয়তো কাভানি, কোরলান, রামিরেজ'দের অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে দল জেতাতে হলে।
দুই দলের ইতিহাস দেখলে, উরুগুয়ে অনেক বড় দল, কলম্বিয়ার চেয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার সর্বকালের সেরা তিন/চার দলের মধ্যে উরুগুয়েকে রাখাই হয় সবসময়। দু'বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নও হয়েছে তারা। কলম্বিয়ার বিপক্ষে খেলা গত ৮ ম্যাচে ৬ বার জিতেছে উরুগুয়ে ,হেরেছে ১ বার। খেলা ড্র ছিলো ১ বার। বিশ্বকাপে এই দু'দল মুখোমুখি হয়েছিলো একবারই। ১৯৬২ সালে। যার ফল ছিলো, উরুগুয়ে ২, কলম্বিয়া ১।
ওদের মধ্যে খেলা হলে গোলও হয় অনেক। গত ৯ খেলায় ৩২ গোল হয়েছে এই দু'দলের খেলায়।
কলম্বিয়া দলেও অবশ্য অনুপস্থিত ওদের সেরা তারকা ফ্যালকাও। ইনজুরির কারণে খেলা হয়নি তার। তবে ফ্যালকাও ছাড়াই প্রতিপক্ষ তিন দলকেই দাপটে হারিয়ে সেরা ১৬য় এসেছে কলম্বিয়া। কিন্তু যে দলগুলোকে হারিয়ে এসেছে তারা- তাদের নাম যেহেতু গ্রিস, জাপান, কোত দি ভোয়া-সেহেতু বলা যাচ্ছে না খুব শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি পেয়েছিলো কলম্বিয়া। সে যা-ই হোক, একটানা তিন ম্যাচ জিতে জয়ের যে অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের, তার ধারাবাহিকতা আজকের খেলায়ও তো থাকার কথা।
সুতরাং এই খেলায় যে কেউ ফেভারিট বললেও গত দুই সপ্তাহের ঘটনা প্রবাহ বিচারে, যার মধ্যে অবশ্যই সুয়ারেজের সাসপেনশন বড় একটা অংশ- কলম্বিয়াই এগিয়ে থাকছে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে।
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এরকম, প্রথম খেলায় যদি ব্রাজিল জেতে, পরেরটায় কলম্বিয়া। তাহলে আগামী শুক্রবার ওরা একে অন্যের মুখোমুখি হবে কোয়ার্টারফাইনালে।
কলম্বিয়া-উরুগুয়ে খেলায় কে জিতলো কে হারলো তা সারা বিশ্বের মাথা ব্যাথা হওয়ার কারণ হবে না তবে কোনো কারণে ব্রাজিল হেরে গেলে এই বিশ্বকাপ রং হারিয়ে ফেলবে অনেকটাই।
কারণ, এই দলটা শুধু তাদের দেশকেই প্রতিনিধিত্ব করছে না, করছে পৃথিবীর কয়েকশ' কোটি মানুষকে। তাদের স্বপ্নকে। হলুদ-হলুদ ভালোবাসাকে!
বাংলাদেশের আধুনিক স্পোর্টস সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মনে করা হয় তাকে। বর্তমানে কানাডার মন্ট্রিয়লে থাকেন। তবে এখনও স্পোর্টস এবং লেখালেখি তার হ্রদস্পন্দনের সাথেই যেনো মিশে আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের আয়োজনে ফরহাদ টিটো লিখছেন বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৪