এত এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞের সহ-আয়োজক হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে সৌদি আরব। যেদিন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ হিসেবে কাতারকে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক নির্বাচিত হয়েছে, সেদিন থেকেই কাতারের কাছ থেকে সম্মানজনক এই অবস্থান কেড়ে নিতে নানান কৌশল খাটিয়ে যাচ্ছে সৌদি।
কিন্তু সৌদি’র জন্য ফিফা’র এত দরদ কেন? আসলে ফিফা’র প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো হচ্ছেন এই পরিকল্পনার মাস্টার-মাইন্ড। ফিফা বস অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন আগামী বিশ্বকাপ হবে ৪৮ দলের, ৩২ দলের নয়। যদিও শুরুতে বলা হয়েছিল ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ হবে ৪৮ দলের। কিন্তু তার আগেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান ফিফা প্রধান। কারণ, ওই সৌদি আরব! যদিও এই কৌশল এতদিন অজানা ছিল সবার কাছেই। কিন্তু ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
৪৮ দলের বিশ্বকাপ বাস্তবায়ন করতে হলে ফিফা’র সমীক্ষা মতে কাতারের বাইরে আরও অন্তত দুটি স্টেডিয়ামে খেলার আয়োজন করতে হবে। আর এখানেই যত বিপত্তি। কেননা, কাতার বলে দিয়েছে তারা ৪৮ দলের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত নয়। তাই এটা এখনো শুধুই পরিকল্পনার পর্যায়েই আছে। আগামী ৬ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ফিফা’র পরবর্তী কংগ্রেসে এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, কাতারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রায় ২ বছর পর।
ফিফা’র এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন সম্ভব হলে বাড়তি ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। ২০০-এর বেশি দেশের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টরা নিশ্চয়ই বাড়তি অর্থ আয়ের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না। ফলে ফিফা’র আগামী কংগ্রেসে ভোটাভুটি হলে অবশ্যই ৪৮ দলের বিশ্বকাপের প্রস্তাব পাস হবে একথা হলফ করেই বলা যায়। কিন্তু কাতারের জন্য তা মোটেও সুখকর হবে না। আবার ফিফা’র সিদ্ধান্ত অমান্য করাও সম্ভব নয়। উভয় দিক থেকেই চাপে পড়ে যাবে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটি।
এখন প্রশ্ন একটাই, ৪৮ দলের বিশ্বকাপ যদি বাস্তবায়ন হয়েই যায়, সেক্ষেত্রে সহ-আয়োজক হিসেবে কোন দেশকে দেখা যাবে? গ্রীষ্মেই এ সমস্যার সমাধান চায় ফিফা। কিন্তু এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক যে অবস্থা তাতে কাতারের সঙ্গে যোগ হতে পারে ওমান ও কুয়েত। কারণ এই দুই দেশই কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধের বাইরে রেখেছে নিজেদের। ফিফা নিজে থেকে এই দুই দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু ওমান ‘প্রস্তুত নয়’ আর কুয়েত আগ্রহই দেখাচ্ছে না।
তবে ফিফা’র সমীক্ষা বলছে, “এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক অবস্থা এবং কাতারের ওপর বাহরাইন, মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরোপিত অবরোধ, আসন্ন বিশ্বকাপে এই দেশগুলোর কোনোটি যদি সহ-আয়োজক হতে চায় তাহলে অবরোধ তুলে নিতে হবে। “ এটা বাস্তবায়ন হলে চুক্তির পথ খুলে যেতে পারে। অর্থাৎ, অবরোধ তুলে নিক সৌদি (যা কাতারের তেমন ক্ষতি সাধন করতে পারেনি) এবং বিনিময়ে তারা (সৌদি ও তার সঙ্গীরা) বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হতে পারবে।
এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, যদি সত্যিই সৌদি ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে কাতারের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েই যায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির দূত হিসেবে দেখা হবে ফিফা প্রধানকে। এজন্য তিনি এমনকি নোবেল পুরস্কারও পেতে পারেন। ফলে ফুটবল বিশ্বকাপের মাধ্যমে সৌদি আরবকে উদারীকরণের বৈশ্বিক পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন হতে পারে। যদিও তা অনেক ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র সঙ্গে জড়িত।
কিন্তু ফিফা প্রধানের উদ্দেশ্য কি আসলেই এত সরল? মোটেই না, বরং তার উদ্দেশ্য তার সবচেয়ে বড় অর্থদাতাদের খুশি করা। গত বছর সৌদি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দুটি নতুন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢেলেছে। ক্লাব বিশ্বকাপ ও গ্লোবাল ন্যাশন্স লিগ নামের এই দুই টুর্নামেন্টে অর্থ এসেছে জাপানের টেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংক থেকে। প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই এসেছে সৌদি আর ইউএই থেকে। এটাকে ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হিসেবে দাবি করেছেন ইনফান্তিনো।
রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে ফিফা’র আয় ছিল ৫.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর গত বছরই এর চেয়ে ঢের বেশ অর্থ ঢেলেছে সৌদি আরব। স্বাভাবিকভাবেই সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতি বাড়তি টান আছে ইনফান্তিনোর। গত বিশ্বকাপে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ফিফা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌদি যুবরাজের একসঙ্গে বসে স্বাগতিকদের বিপক্ষে সৌদি আরবের ম্যাচ উপভোগ করার সেই দৃশ্য তো তুমুল সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
সবমিলিয়ে ৪৮ দলের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে অখুশি হলেও বাধ্য হয়ে ফিফা’র সঙ্গে আলোচনা করতে হচ্ছে কাতারকে। ১০ বছর ধরে যে পরিকল্পনা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কাতার, এখন সেখানে সৌদি আর ফিফা’র হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া সহজ কাজ নয়। প্রস্তুতির শুরুতে শ্রমের নিম্নমান এবং ঘুষ দিয়ে আয়োজক নির্বাচিত হওয়ার অভিযোগ পার হওয়ার পর সব যখন গুছানো প্রায় শেষে, ঠিক তখন সহ-আয়োজক হিসেবে সৌদি কিংবা আমিরাতকে মেনে নেওয়া, কাতারের জন্য এটা বিশাল পরাজয়।
তবে সৌদি আরবের সব প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিতে পারে কাতার। কারণ, ফিফা’র সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে ৩২ দলের বিশ্বকাপ আয়োজনের। কিন্তু যদি সৌদি আরব তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে আদতে ফুটবলের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কমে যাবে বলে ধারণা করছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সৌদি যতই অর্থ ঢালুক, মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের প্রতি সমর্থন নেই অধিকাংশ মানুষের। সৌদি যদি সত্যিই সহ-আয়োজক হয়েও যায়, তাহলে বিশ্বের কাছে যে বার্তা যাবে তা হলো: যত ইচ্ছে পাশবিক হও। ক্ষমতাবানদের কোনো সাজা হবে না।
-ফিনান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৯
এমএইচএম